মুসলিম বিশ্বনেতাদের ইসরাইলপ্রীতি

রাফাহ শহর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন! খবর আসছে- সেখানে আর কেউ বেঁচে নেই। চারপাশে শুধু ছাই, ধ্বংস আর নীরবতা। জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। পরিশেষে বলব, আমেরিকা ও ইসরাইলের অত্যাচারে গাজা মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ল। আর এর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করল ট্রাম্প। আমেরিকা, ইসরাইল ও ভারত-তিন শক্তি জোটবদ্ধ হয়েই মুসলিম নিধনে নেমে পড়েছে। আর ৫৭টি মুসলিম দেশের রাজারা বেঁচে আছে তাদের তল্পিবাহক হিসেবে!

সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে একটি লোমহর্ষক ভিডিও। তাতে দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের বোমা হামলার নৃশংস দৃশ্য। ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে কিছু মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ ছিটকে পড়ছে চারদিকে। আর ঔদ্ধত্যের সাথে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘এটা কেবল শুরু’।

গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যেও দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তাহলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে।

এ ছাড়া প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ২ মার্চ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেয় ইসরাইল সরকার। পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের পাসওভার উৎসব এই মেয়াদকালের আওতায় পড়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরাইল আবারো গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে।

১৮ মার্চ মঙ্গলবার ঘড়িতে তখন রাত ২টা ১০ মিনিট। মেয়ে বানিয়াসকে নিয়ে গভীর ঘুমে গাজার অধিবাসী মারাম হুমাইদ দম্পতি। আচমকা যুদ্ধবিমান থেকে একের পর এক বোমা হামলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বানিয়াসের। শিশুটির চোখেমুখে তখন আতঙ্ক। চিৎকার করে কাঁদছিল আর বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘বাবা! মা! কী হচ্ছে বাইরে?’

মারাম হুমাইদ বলেন, ‘মেয়ে শুয়ে ছিল আমার পাশে। তাকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় মেয়েকে আমি কোলে জড়িয়ে রাখি। হামলার তীব্রতা আরো বাড়তে থাকে। বুঝতে পারছিলাম আবার ইসরাইল হামলা শুরু করেছে।’

চার পাশে ইসরাইলের নির্বিচার বোমা হামলার শব্দে ঘুম ভাঙে গাজার স্কুলশিক্ষক আহমেদ আবু রিজক ও তার পরিবারের। তিনি বলেন, ‘আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। শিশুরাও ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন সড়ক থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসতে শুরু করে। দেখি লোকজন তাদের সন্তানদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ নিয়ে আশপাশের হাসপাতালের দিকে ছুটে যাচ্ছে।’

মোমেন কোরেইকেহ নামে গাজার আর এক বাসিন্দা বলেন, সোমবার মধ্যরাতে ইসরাইলের এই হামলায় নবজাতক, নারী-শিশুসহ পরিবারের ২৬ জন সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত গাজায় চলমান এ তথ্যগুলো ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

গাজায় সংবাদকর্মে নিয়োজিত আলজাজিরার প্রতিনিধি তারেক আবু আজম। তিনি জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অস্থায়ী হাসপাতাল, আবাসিক ভবন-সর্বত্র বিমান থেকে বোমা হামলা অব্যাহত রয়েছে। হামলায় হামাসের কিছু শীর্ষ নেতাও নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে চালানো হামলায় নিহত হয়েছে অগণিত মানুষ। নবজাতক, শিশু, নারী ও প্রবীণ মানুষের অসাড় দেহ পড়ে রয়েছে যত্রতত্র। দাফন-কাফনেরও সুযোগ দিচ্ছে না অভিশপ্ত ইসরাইলি বাহিনী। ফলে বনি আদমের অনেক লাশ কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। গত দেড় বছরে ইসরাইলের অমানবিক নৃশংসতা গাজাকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। গাজার নৃশংসতার কাছে পৃথিবীর সব নৃশংসতা হার মেনেছে। এক ভয়াবহ অমানবিক দৃশ্যের নাম হলো গাজার রাফাহ নগর, যা মিসরের সীমান্তে অবস্থিত।

এ নগরীর বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে গাজার বাসিন্দা সালেহ আল জাফরী মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে ফেসবুকে এক চিঠি লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘মিসর সীমান্তে গাজার ছোট্ট নগর রাফাহ। ওরা গাজার সব স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে অনেক আগেই। প্রাণ বাঁচাতে রাফাহতে অবস্থান করছিল বেঁচে থাকা অসহায় ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু সেই রাফাহ আর অবশিষ্ট নেই। ইসরাইল পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়েছে রাফাহকেও! আর অল্প সময়ের মধ্যে গাজা নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে। একটি একটি করে আলো নিভে যাচ্ছে, একটি একটি করে নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে। আমরা বাঁচার আর্তনাদ পাঠালেও পৃথিবীর কানে সে আর্তনাদ পৌঁছেনি। আপনারা আমাদের কেবল জান্নাতে খুঁজে পাবেন।

বিদায়! হে ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর উম্মত...।’

তিনি আবেগঘন ভাষায় আরো লিখেছেন, ‘আজকের ইতিহাস হয়তো কিছুই মনে রাখবে না। কিন্তু আকাশ-পাতাল লিখে রাখবে এই কান্না, এই নীরব ধ্বংসযজ্ঞ। ইতিহাসের পাতায় এ কথা লেখা থাকবে যে, পাকিস্তান ছিল বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তবু গাজা রক্ষার্থে তারা এগিয়ে আসেনি। ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাকিস্তান টুঁ শব্দটিও করেনি।

মিসরের বুকচিরে বয়ে চলেছে নীলনদ। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহমান বিশাল এক স্রোতস্বিনীর নাম। যা প্রাণ জুগিয়েছে আফ্রিকার মরুভূমিকে। অথচ পাশেই গাজার শিশুরা তৃষ্ণায়-পিপাসায় কাঁপতে কাঁপতে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। তৃষ্ণার্ত শিশুদের একফোঁটা পানিও দেয়নি এ মিসর!

গোটা বিশ্বের মুসলমানদের ছিল ৫০ লাখ সৈন্য, ছিল ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বাহিনী, ছিল আধুনিক প্রযুক্তি এমনকি পরমাণু বোমাও। কিন্তু গাজার আকাশে একটিরও ছায়া পড়েনি। গাজার দিকে কেউ হাঁটেনি। গাজাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি।

সৌদি আরব আর আরব আমিরাতে রয়েছে তেলের খনি। অথচ তেলের অভাবে গাজার হসপিটাল ও অ্যাম্বুলেন্সগুলো অচল।

আমাদের আগামীর প্রজন্ম জানবে, এই পৃথিবীতে ২০০ কোটি মুসলিম ছিল, কিন্তু কেউ ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল না।

তখন তারাই আমাদের কাপুরুষ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত করবেন!

এখন এটাই প্রমাণিত যে, পৃথিবীতে একমাত্র মুসলিম দেশ হলো ফিলিস্তিন (গাজা) আর বাকি সব দেশ অমুসলিম! পৃথিবীতে মুসলমান আছে শুধু ফিলিস্তিনের গাজায়! পৃথিবীর অন্য কোথাও মুসলমান নেই! মানব ইতিহাস এই ঘৃণ্য স্মৃতি কিভাবে সংরক্ষণ করবে?’

তিনি আরো লেখেন, ‘গাজায় ধ্বংস হওয়ার মতো আর কিছু বাকি নেই। এদের দেখে আমার কোনো আফসোস নেই। কারণ ওরা জান্নাত পেয়ে গেল। তবে আফসোস হচ্ছে নিজের জন্য যে, আমরা বেহুদাই ইমাম মেহদী এলে তার দলে যোগ দেয়ার আশায় কাপুরুষ, নামমাত্র ব্যর্থ কলঙ্কিত মুসলমান হিসেবে বেঁচে রইলাম।

সবকিছু থাকবে ইতিহাসে। গাজার মতোই জ্বলছে কাশ্মির, উইঘুর, রোহিঙ্গা, ভারত সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের অগণিত জনপদ। সব ইতিহাসই লেখা হবে। তবে সবচেয়ে করুণভাবে লেখা থাকবে এই কথা যে, মুসলিমরা চুপ ছিল। সবাই নীরব ছিল। মৃত্যুর চেয়েও গভীর ছিল সে নীরবতা।

আর এই নীরবতা ভাঙতেই হয়তো শেষ সময়ে এসে ইট পাথরে কথা বলবে।

গাজার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলজাজিরার এক প্রতিবেদন এখানে উল্লেখ করা হলো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার প্রতিটি এলাকায় এখন নিয়মিতভাবে নিষিদ্ধ ফ্লোরিন বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে!

প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে মিসাইল ছোড়া হচ্ছে! ফলে পুরো অঞ্চলটি মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

আলজাজিরা, CNN, NBC-সহ সব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের গাজা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে ইসরাইল। কোনো মিডিয়াকে সেখানে রিপোর্ট করতে দেয়া হচ্ছে না। বাস্তবতা ঢেকে রাখা হচ্ছে বিশ্ববাসীর চোখ থেকে। এখন গাজার মানুষের জন্য খাবার নয়, দরকার অক্সিজেন। বাতাসে বিষ- নিঃশ্বাসও এখন প্রাণঘাতী।

রাফাহ শহর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন! খবর আসছে- সেখানে আর কেউ বেঁচে নেই। চারপাশে শুধু ছাই, ধ্বংস আর নীরবতা। জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।

পরিশেষে বলব, আমেরিকা ও ইসরাইলের অত্যাচারে গাজা মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ল। আর এর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করল ট্রাম্প।

আমেরিকা, ইসরাইল ও ভারত-তিন শক্তি জোটবদ্ধ হয়েই মুসলিম নিধনে নেমে পড়েছে। আর ৫৭টি মুসলিম দেশের রাজারা বেঁচে আছে তাদের তল্পিবাহক হিসেবে!

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া