কাঁচা চামড়ার দুর্গতি কবে শেষ হবে

কোরবানির ঈদকে ঘিরে লবণমুক্ত ও লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া ক্রেতাদের সিন্ডিকেট ভেঙে এই খাতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অনৈতিক দালালি, চামড়া পাচার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলে সার্বিকভাবে মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। একই সাথে ঈদের দিনে কোরবানিদাতাদের চামড়া নিয়ে ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে, সেই সাথে এতিম মিসকিনরা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাবে। সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে।

আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি- পাট, চা ও চামড়া দেশের অন্যতম রফতানিকারক পণ্য। যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে গার্মেন্ট পণ্য ও জনশক্তি রফতানি। চা ও পাট তাদের গৌরব কিছুটা ধরে রাখতে পারলেও চামড়া ব্যবসায় ধস নেমেছে। বিশেষ করে প্রান্তিক লেভেলে কাঁচা চামড়া বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বছরের পর বছর ধরে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে পাট উৎপাদন এবং পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের মূল্যমান ভালো থাকলেও পাট থেকে আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে না। চা উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম। বাংলাদেশ চা-বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে সাড়ে ২৪ লাখ কেজি চা রফতানি হয়েছে আর উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা। ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছিল ১০ কোটি দুই লাখ কেজি। যা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ২ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী দেশ চীন। এরপর ভারত, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। তা ছাড়া বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য অন্যতম পণ্য হলো পশুর চামড়া। বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশু কাঁচা চামড়ার দামে ধারাবাহিক পতন অব্যাহত রয়েছে। এই বছর সরকারিভাবে দাম কিছুটা বৃদ্ধি করা হলেও প্রান্তিক লেভেলে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এ বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করলেও কোরবানির পর বিক্রেতারা সেই দামের সুফল পাননি। গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগল আর গাভীর চামড়া বিক্রয়ের কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি। এই ঈদে ঢাকায় গরু বা মহিষের কাঁচা চামড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও সরকারিভাবে ছোট গরুর প্রতি পিস চামড়ার দাম ঢাকায় এক হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

কাঁচা চামড়া এই মূল্য পতনের জন্য অনেকেই ট্যানারি শিল্পের সীমাবদ্ধতা বিশেষ করে সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা চামড়া শিল্পের বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া, শিল্পপার্কে সব কারখানা উৎপাদনে না যাওয়া এবং ১০টির বেশি লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকা ইত্যাদি নানাবিধ কারণকে দায়ী করেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এখনো আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে না পারায় বাংলাদেশের অধিকাংশ ট্যানারি এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সনদ পাচ্ছে না। ফলে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে চামড়া রফতানির সুযোগ পাচ্ছে না। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মানদণ্ডে যেখানে ভারত ১৩৯টি, চীনে ১০৩টি, ইতালিতে ৬৮টি, পাকিস্তানে ৪১টি, ব্রাজিলে ৬০টি, তাইওয়ানে ২৪টি, থাইল্যান্ডে ২২টি, স্পেনে ১৭টি, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬টি এবং ভিয়েতনামে ১৪টি ট্যানারি এ সনদ পেয়েছে। বাংলাদেশের মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান এ সনদ পেয়েছে। চামড়ার উৎপাদন ও এর ব্যবসার তুলনায় এটা একেবারে নগণ্য। যেখানে আমাদের ২২০টি ট্যানারি এবং অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও চামড়া শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক কারখানা বিদ্যমান।

বাণিজ্য, বস্ত্র ও পাট এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত ১০ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ বেশি দামে চামড়া ট্রানজেকশনের দাবি করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশের বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পর কাঁচা চামড়া ক্রেতা বা দাম না পাওয়ায় অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে সারা বছরই পশু জবাই হয়ে থাকে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে যে পরিমাণ চামড়া সংগৃহীত হয় তার মধ্যে শুধু কোরবানির ঈদে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চামড়া সংগৃহীত হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য মতে, এই বছর দেশে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কোরবানি হয়েছে। যার মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যাই বেশি। কোরবানির পশু অবিক্রীত রয়েছে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ৬০৩টি।

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠে। গ্রামীণ কৃষক, ছোটো-বড় খামারিদের পশু লালনপালন ও সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলে। প্রান্তিক লেভেলে চামড়ার দাম বেশি থাকলে কৃষক ও খামারিরা পশুর মূল্য কিছুটা হলেও বেশি পেয়ে থাকে। বিশ্ববাজারে এ দেশের সব ধরনের চামড়ার চাহিদা রয়েছে তথাপি সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দেশে চামড়ার বাজারে ধস নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে কোরবানিদাতা, মৌসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে পানির দরে কম মূল্যে চামড়া বিক্রি করেছেন।

কোরবানির কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এতিম ও দুস্থ মানুষ। আমরা দেখেছি, একসময় ঈদের দিন বিকেল থেকেই এতিম অসহায় ও দুস্থ মানুষ যারা কোরবানি দিয়েছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া বিক্রির টাকা আনত। তখন একটি ভালো গরুর চামড়া দুই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। কারণ কোরবানি দাতারা তো চামড়া বিক্রিই করতে পারে না অথবা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে এখন আর চামড়ার টাকার জন্য কারো বাড়িতে যায় না। এই বছর সরকার লবণ মিশিয়ে সেটি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ওয়েট ব্লু আকারে বিদেশে রফতানি করার অনুমতি দিলেও বিভিন্ন কারসাজি করে প্রান্তিক লেভেলে চামড়া ক্রয়ে জটিলতা সৃষ্টির কারণে দাম বৃদ্ধি পায়নি।

আমরা মনে করি, কোরবানির ঈদকে ঘিরে লবণমুক্ত ও লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া ক্রেতাদের সিন্ডিকেট ভেঙে এই খাতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অনৈতিক দালালি, চামড়া পাচার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলে সার্বিকভাবে মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। একই সাথে ঈদের দিনে কোরবানিদাতাদের চামড়া নিয়ে ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে, সেই সাথে এতিম মিসকিনরা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাবে। সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট