জেগে উঠুক এনবিআর

জাতীয় রাজস্বের ৮৮ শতাংশ আসে এনবিআর থেকে, অর্থাৎ এই সংস্থার শক্তি মানেই জাতির সম্ভাবনা। তাই দুর্বলতা মানে অগ্রযাত্রায় বাধা, আর সৎ নেতৃত্ব মানেই উন্নয়নের নবজাগরণ। যদি আমরা সঠিক দৃষ্টি, সাহসিকতা ও দূরদর্শী রূপকল্প নিয়ে এনবিআর সংস্কারে অগ্রসর হই, তাহলে আর কোনো দেশের দয়া বা ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে না। আজ অর্থ উপদেষ্টা এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট সদস্যদের সক্রিয় ও দূরদর্শী পদক্ষেপে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জাগরণ ঘটেছে। এই জাগরণই হতে পারে দুর্নীতিমুক্ত, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশের সূচনা। এখন সময় সংস্কার নয়, জাতির ভবিষ্যৎ বদলানোর। এনবিআর সংস্কার হোক আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক রেনেসাঁর শুরু

বাংলাদেশের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮৮ শতাংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে। এই একটি সংস্থার সুশাসন ও দক্ষতা পুরো দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। যদি এনবিআরকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করে গড়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল নয়, উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারবে।

বর্তমানে সরকার আইএমএফের পরামর্শে এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করার উদ্যোগ নিয়েছে, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। অথচ এ সময়েই একটি দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র দেশকে জিম্মি করে করাপ্ট শাটডাউন সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তবে সরকারের সদিচ্ছায় এনবিআরের সাহসী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, জনগণের আশা নতুন করে জেগে ওঠে।

আজ এনবিআরকে ঘিরে যে সংস্কার-আন্দোলন শুরু হয়েছে সে প্রেক্ষাপটে আমি আমার প্রেষণকালীন কর্মজীবনে সংগৃহীত তিনটি বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি, যেগুলো নীতিনির্ধারণ, স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমি এসব অনিয়ম নিজের চোখে দেখেছি, রিপোর্ট করেছি, যাতে দেশ উপকৃত হয়, মানুষ সচেতন হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানে দুর্নীতির অন্ধকার থেকে উঠে আসতে কেমন সাহস, তথ্য ও সততা দরকার।

এই গল্পগুলো ক্ষুদ্র হলেও, এর প্রভাব ছিল গভীর। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এনবিআর হয়ে উঠতে পারে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রধান শক্তি।

১ম গল্প : বেনাপোল-পেট্রাপোল দলিল বিভ্রাটে চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকি

২০০৪-০৫ সাল। বেনাপোল স্থলবন্দরে দুর্নীতি তখন ছিল খোলাখুলি, স্বাভাবিক নিয়মেই চলছিল ফাঁকি ও চাতুর্য। অনিয়মের তথ্য ছিল কিন্তু সত্য খুঁজে বের করা ছিল কঠিন। ভিন্ন উপায়ে চিন্তা করলাম কেননা করতেই হবে।

মাসভিত্তিক একটি নির্দিষ্ট সময়ে বেনাপোল স্থলবন্দরে আসা ভারতের পেট্রাপোল থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের তালিকা (Export Items List) এবং সেই একই সময়ের যা বেনাপোল- বাংলাদেশের জন্য আমদানি হওয়া পণ্যের তালিকা (Import Items List) আমি সংগ্রহ করেছিলাম। ব্যাপারটা জটিল ও কষ্টসাধ্য ছিল বিশেষ করে ভারতীয় কাস্টম হাউজ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের তালিকা সংগ্রহ করা। লক্ষ্য ছিল, রফতানি-আমদানির তথ্য মিলিয়ে দেখা, যা দেখা গেল তা ছিল ভয়াবহ।

একটি নির্দিষ্ট দিনের ভারতীয় পেট্রাপোল দলিলে লেখা ছিল যেমন ১০০০ মিটার রেমন্ড কাপড় রফতানি হয়েছে বাংলাদেশে, অথচ আমাদের বেনাপোল কাস্টমসের নথিতে দেখা গেল মাত্র ৫০০ মিটার সাধারণ মানের কাপড়। আবার কোথাও দেখা গেল সাইকেলের যন্ত্রাংশের পরিবর্তে লেখা চালের বস্তা! এমন অনেক পার্থক্য ও অনিয়ম পেলাম।

এই ‘অদৃশ্য’ হেরফের ছিল মূলত বাংলাদেশী আমদানিকারক ও কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তার যৌথ কারসাজির ফসল। আমদানিকারকরা ঘুষ দিয়ে কর্মকর্তাদের দিয়ে নথিপত্র বদলে ফেলতেন, যাতে কম কর দিতে হয়, বা ফাঁকি দেয়া যায়। এই বিশ্লেষণী অনুসন্ধান শেষে আমি একটি বিশদ প্রতিবেদন জমা দিই সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে। এই প্রতিবেদন কার্যত একটি আই ওপেনার (Eye Opener) হয়ে দাঁড়ায়। এর পর থেকেই বেনাপোলে রাজস্ব আদায়ে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। রাজস্ব আদায় প্রায় দেড়-দ্বিগুণ হয়ে যায়।

এরপর বেনাপোল কাস্টমসে তোলপাড় শুরু হয়। একজন সংশ্লিষ্ট অফিসারকে উচ্চ পদ থেকে অন্যান্য কারণসহ ওএসডি করা হয়েছিল। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন, আর আগের মতো স্বেচ্ছাচার চলবে না। তখন এনবিআরকে (NBR) প্রভাবিত করতে পেরেছিলাম নীতিগত সংস্কারের দিকেও।

এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, শুধু নীতিমালা নয়, বাস্তব চর্চা ও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই রাজস্ব ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে কার্যকর সংস্কার সম্ভব। এটি একা একজন কর্মকর্তা বা একজন মানুষও করে ফেলতে পারেন, যদি তার মধ্যে থাকে দেশপ্রেম, সততা ও কিছুটা সাহস।

২য় গল্প : ঢাকা বিমানবন্দরের অদৃশ্য রাজনীতি

আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগের ঘটনা এবং একটি সংস্থায় প্রেষণে কর্মরত। লক্ষ্য করলাম, সংস্থার কিছু কর্মচারীর তদবিরের মাধ্যমে ঢাকার বিমানবন্দরে বদলি হওয়ার অদ্ভুত আগ্রহ। বিষয়টি আমার কৌতূহল জাগায়। বিভিন্ন রিপোর্ট, গোপন তথ্য ও পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে একসময় বেরিয়ে আসে একটি বিস্ময়কর চিত্র, টেলিযোগাযোগ খাতে, বিশেষ করে মোবাইল সেট আমদানিতে, সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

সেই সময় মোবাইল সেট আমদানিতে প্রতি ইউনিটে কর ছিল এক হাজার ৫০০ টাকা। এক দিকে মোবাইল সেট ছিল আকর্ষণীয় ও স্ট্যাটাসের প্রতীক অন্য দিকে এত বেশি করের কারণে বৈধ পথে আমদানির চেয়ে অনেকে চোরাচালানকেই নিরাপদ ব্যবসা হিসেবে বেছে নিচ্ছিল। তারা যাত্রীর ছদ্মবেশে ব্রিফকেসে করে ন্যূনতম ১০০টি মোবাইল ফোন পার্সোনাল ব্যাগেজ হিসেবে নিয়ে আসতো এবং বিভিন্ন এজেন্সির সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেত। একেকটি ট্রিপে সেই সময় যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে যেখানে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হতো, সেখানে শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে তাদের লাভ থাকত অন্তত ১০০টি ফোন এক লাখ টাকা। কেউ কেউ ধরা পড়লেও কোনো চিন্তা ছিল না, কর আদায়ের সমপরিমাণ বা একটু বাড়তি ‘দাওয়াতি খরচ’ দিলেই ছাড় মিলত।

একজন কর্মকর্তা হিসেবে ভেতরের এই পচন সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সিদ্ধান্ত নিই, এই চক্রে প্রথম আঘাত আসবে ঢাকা বিমানবন্দর বদলির ওপর। কয়েক দিনের জন্য পুরো চোরাচালান প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে। এ ব্যবস্থাটি প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিমানবন্দরে কয়েক দিন দুর্দান্তভাবে কাজ করেছিল। কিন্তু দুর্নীতি যে স্থির বসে থাকে না, তা অচিরেই বুঝতে পারি। স্মার্ট ব্যবসায়ীরা এটি বিকল্পভাবে হিসেবে চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহার শুরু করে। আমি বুঝতে পারি, এটা শুধু একটা লোকাল সমস্যা নয়, এটা গোটা সিস্টেমের দুর্বলতা, যেখানে করনীতির অসঙ্গতি, দুর্বল নজরদারি এবং প্রতিষ্ঠানগত স্বচ্ছতার অভাব একে অপরকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।

এ ঘটনার পর আমি শুধু সমস্যার উপরে হাত না দিয়ে মূল নীতিগত জায়গায় আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিই, যার সূত্র ধরে আসে আমার সিম-ভিত্তিক রাজস্ব মডেল এবং কর পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ, যা পরবর্তীতে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণে সহায়ক হয়।

ট্যাক্স ফাঁকি রোধে প্রতিটি মোবাইল সেটের জন্য এক হাজার ৫০০ থেকে ৫০০ টাকা কমিয়ে আনার প্রস্তাব করি, তখন এনবিআর চেয়ারম্যান খায়রুজামান চৌধুরী বিরক্ত হন। তখনই অন্য পথে সৃজনশীলভাবে সমাধান খুঁজে, প্রস্তাব দিই, প্রতি মোবাইল সেটে ট্যাক্স কমিয়ে ৩০০ টাকা করা হোক এবং সিমকার্ডের ওপর এক হাজার ২০০ টাকা ট্যাক্স স্থানান্তর (ধার্য) করা হোক। কারণ মোবাইল কিনলে সিম লাগবেই, এটাই ব্যবসার প্রাকৃতিক চেইন। ফলে মোবাইল সেট চোরাচালানের কোনো লাভ থাকবে না, কর ফাঁকি বন্ধ হবে, এবং সরকারও রাজস্ব হারাবে না।

আমি উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান ও ভারতকে তুলে ধরি, যেখানে একই ধরনের ব্যবস্থা চালু ছিল, সেট নয়, বরং সিমের ওপর কর বসানো হয়েছিল বেশি। আমার প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করি ২০০৪-০৫ অর্থবছরে দেশে ২৪ লাখ সিম বিক্রি হয়েছিল। সেক্ষেত্রে মোবাইল সেট বিক্রি হওয়ার কথা সমানসংখ্যক ২৪ লাখ। ৩৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আসার কথা ছিল। কিন্তু সরকার পেয়েছিল মাত্র ৬ লাখ মোবাইল সেটের কর, অর্থাৎ ৯০ কোটি টাকার মতো। এখানে প্রায় ২৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল এক অর্থবছরেই।

সবশেষে তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ ও কার্যকর যুক্তির কারণে এনবিআর চেয়ারম্যান আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ সিদ্ধান্ত শুধু মোবাইল চোরাচালান রোধ করেই থেমে থাকেনি, পরবর্তীতে এ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১০ কোটি সিম ব্যবহারকারী থেকে এনবিআর ৮ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব সংগ্রহ করে, যা এক অনন্য নজির হয়ে থাকে।

২০২৪ সালের ২৪ জুন জাতীয় সংসদে জানানো হয়, দেশে নিবন্ধিত সিমের সংখ্যা ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৫৬ হাজার ৯৭০টি, যদিও এর মধ্যে অনেক নিষ্ক্রিয় সিমও রয়েছে। এই সংখ্যা নিজেই প্রমাণ করে, সময়োপযোগী একটি চিন্তা কতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে এবং কেমন করে একটি ছোট নীতিগত সিদ্ধান্ত রাজস্ব আহরণের নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।

৩য় গল্প : মোবাইল অপারেটর লাইসেন্স ফি

আমাদের দেশে চারটি মোবাইল কোম্পানি ১৯৯৭ সাল থেকে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে এবং বাংলাদেশ সরকার মাত্র ৯ কোটি টাকা করে চারটি মোবাইল অপারেটরকে লাইসেন্স দেয়। অথচ একই সময়, পাকিস্তানে যখন চারটি মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স দেয়া হয়, প্রতিটির ফি নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা, মোট রাজস্ব সাত হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মোবাইল সেট চোরাচালান বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করতে গিয়ে আমি যখন প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি, তখনই স্পষ্ট হয় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও আমলারা আদৌ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন।

আমার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করা হলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পাকিস্তানি অর্থমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি জানান, কেবল পাকিস্তান নয়, তিউনিসিয়াতেও দুটি কোম্পানি থেকে ৫০ কোটি ডলার লাইসেন্স ফি আদায় হয়েছিল, যা তাদের দুর্বল অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করে। উক্ত বিষয়গুলো ৩০ জুন ২০০৫ প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, ডেইলি স্টারসহ বেশ কিছু পত্রিকায় আসে।

তথ্য অনুসন্ধানের সময় আরো জানতে পারি, তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী (যিনি একসাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন) মাত্র ৯ কোটি টাকা ফিতে লাইসেন্স দেন। এমনকি এও অনুমান করা যায়, তিনি এতটাই অজ্ঞ ছিলেন যে জানতেনও না, এই লাইসেন্সের মাধ্যমে কত বড় রাজস্ব আদায় সম্ভব ছিল, এবং কতটা বিনিময় সুযোগ ‘চাওয়া উচিত’ ছিল! আর সেই অজ্ঞতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির ফলেই সাত হাজার ৬০০ কোটি টাকার পরিবর্তে সরকার পেয়েছে মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। অথচ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের পরিমাণই ছিল মাত্র ২৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা; অর্থাৎ মাত্র চারটি লাইসেন্সেই প্রায় ৩০ শতাংশ বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ হারিয়েছে রাষ্ট্র।

ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে হলে এর পরবর্তী ধাপটিও জানা জরুরি। ২০০৬-০৭ সালে মোবাইল অপারেটর ‘ওয়ারিদ বাংলাদেশ এর নতুন নেটওয়ার্ক চালু করার আগে বিটিআরসি নতুন চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পূর্ব পরিচয় থাকায় লাইসেন্স ফি গ্রহণের পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য দেখা করি। পরে তিনি আমাকে জানান যে সব কিছু বিবেচনা করে লাইসেন্স ফির জন্য ৩৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এক হাজার ৯০০ কোটি টাকায় নেয়া হলে তাহলে প্রতিযোগিতায় তার টিকে থাকা সম্ভব হতো না যেহেতু অন্য কোম্পানি থেকে নামমাত্র শুধু ৯ কোটি টাকা করে পূর্বে নেয়া হয়েছিল। এটি শুধুই একটি উদাহরণ বা গল্প নয়, এটি প্রমাণ করে যে সঠিক পলিসি ও দেশাত্মবোধক জ্ঞান ছাড়া রাষ্ট্র কিভাবে আত্মঘাতী হতে পারে।

আজকের প্রেক্ষাপটে এই রাজস্ব আদায় বা হারানোর অঙ্কগুলো ছোট মনে হলেও, দুই-তিন দশক আগে তা জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০-৩০ শতাংশের সমান ছিল। কেবল এই তিনটি অভিজ্ঞতা নয়, আমার পেশাগত জীবনে এমন বহু ঘটনা দেখেছি, যা রাষ্ট্রের রাজস্ব অপচয়, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। তবে প্রতিটি বিষয়ে নিজেকে জড়ানো সম্ভব হয়নি, কারণ দায়িত্ব ছিল বহুমাত্রিক। এই তিনটি গল্প শত শত অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি মাত্র। ভাবুন, যদি এই তিনটি ক্ষেত্রেই সরকারের হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যায়, তবে পুরো এনবিআর কাঠামো ঢেলে সাজালে কেমন রূপান্তর সম্ভব?

জাতীয় রাজস্বের ৮৮ শতাংশ আসে এনবিআর থেকে, অর্থাৎ এই সংস্থার শক্তি মানেই জাতির সম্ভাবনা। তাই দুর্বলতা মানে অগ্রযাত্রায় বাধা, আর সৎ নেতৃত্ব মানেই উন্নয়নের নবজাগরণ। যদি আমরা সঠিক দৃষ্টি, সাহসিকতা ও দূরদর্শী রূপকল্প নিয়ে এনবিআর সংস্কারে অগ্রসর হই, তাহলে আর কোনো দেশের দয়া বা ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে না। আজ অর্থ উপদেষ্টা এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট সদস্যদের সক্রিয় ও দূরদর্শী পদক্ষেপে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জাগরণ ঘটেছে। এই জাগরণই হতে পারে দুর্নীতিমুক্ত, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশের সূচনা। এখন সময় সংস্কার নয়, জাতির ভবিষ্যৎ বদলানোর। এনবিআর সংস্কার হোক আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক রেনেসাঁর শুরু।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌ বাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি
[email protected]