নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতা একজন শাসককে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী ভাবতে শেখায়। সে তখন ভুলে যায় বিধিলিপি বা নিয়তির কথা, যা তাকে অদৃশ্য থেকে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় শেষ পরিণতির দিকে। মানব ইতিহাসজুড়ে রয়েছে- অসংখ্য শাসকের উত্থান-পতনের কাহিনী, যারা সবসময় নিজেদের ভাগ্যবিধাতা মনে করত। তারা ভাবত তাদের জীবনের কোনো কিছু পূর্বনির্ধারিত না, তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্যনির্ধারক।
আসলে আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির অনেক আগে তাদের তকদির লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন- ‘নিশ্চয় আমরা সবকিছু সৃষ্টির আগেই তাদের ভাগ্য কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি।’ (সূরা আল কামার, আয়াত-৪৯) মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগে সেসবের তকদির লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, যা তিনি ছাড়া কেউ জানে না। তবু মানুষ শক্তির মদমত্ততায় কিংবা অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে নিজেকে ভাগ্যনিয়ন্ত্রক ভাবে।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রচলিত গল্পের কথা উল্লেখ করতে চাই। সেটি হচ্ছে : একবার ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে এক জ্যোতিষী হাত দেখে বলেছিলেন, আপনার হাতে ভাগ্যরেখা নেই। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম ভূমিকা পালনকারী এবং দিগি¦জয়ী এ সম্রাটের পক্ষে তা মেনে নেয়া খুব কঠিন ছিল। তাই কথিত আছে, নেপোলিয়ন চাকু দিয়ে তার হাতের তালুতে একটি রেখা টেনে বলেছিলেন, এটিই আমার ভাগ্যরেখা। যিনি দেশের পর দেশ জয় করে ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতিমান সমরনায়ক হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়েছিলেন- সেই তিনি কিভাবে মেনে নেবেন যে, তার হাতে ভাগ্যরেখা নেই। কিন্তু বিধির বিধান কে খণ্ডাবে? পৃথিবীতে নিজেকে যে যত ক্ষমতাবান মনে করুক না কেন, তাকে নিয়তির অবশম্ভাবী পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ফরাসি সম্রাট ভাগ্যরেখা টেনে হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা, তিনি চির বিজয়ী থাকবেন চিরকাল। কখনো ভাবেননি, একদিন তাকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নির্জন একটি দ্বীপে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হবে। ওয়াটার লু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নির্বাসিত হয়েছিলেন দক্ষিণ আটলান্টিকের অত্যন্ত নির্জন দ্বীপ-সেন্ট হেলেনায়। সেখানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৫১ বছর বয়সে এ বীরের জীবনাবসান ঘটে। নিজের সৃষ্ট ভাগ্যরেখা তার প্রকৃত ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কারণ ওটা কোনো মানুষের হাতে নেই। খোদ আল্লাহ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত।
আসলে মানুষ ভুলে যায় তার নিয়তির কথা। শুধু ভুলে যাওয়া নয়, মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাও সে বুঝতে পারে না। আজকাল অনেকে বলে থাকেন, আল্লাহ ছাড় দেন; কিন্তু ছেড়ে দেন না। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ জালিমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে তাকে এমনভাবে পাকড়াও করেন যে, সে আর ছুটে যেতে পারে না।’ (বুখারি-৪৬৮৬) সেই সাথে এটি ঠিক যে, মানুষ যখন অব্যাহতভাবে খারাপ কাজ করতে থাকে আল্লাহ তখন তাকে ছাড় দিতে থাকেন। মূলত মানুষ যখন আল্লাহর বিধানবহির্ভূত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাকে ভুলে যান। এ অবস্থায় মানুষ প্রচণ্ড অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। সে নিজেকে এতটা শক্তিশালী ভাবে যা তাকে নিজের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হিসেবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। চরম কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ক্ষেত্রে এ ধরনের অহঙ্কার ও শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা আমরা দেখে আসছি। এমনকি তাদের পোষ্যরা পর্যন্ত সেভাবে ভাবতে থাকে। জুলুমে জড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের শাসকদের হাতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত সব আইন-কানুন চরমভাবে উপেক্ষিত হয়। তারা যা খুশি তা করতে পছন্দ করে। এমনকি তাদের মতাদর্শবিরোধী যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা তারা একটি স্বাভাবিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু তাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে তারা অনবহিত থেকে যায়। যেমনটি নেপোলিয়ন জানতে পারেননি। কিংবা বাংলাদেশের পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চব্বিশের জুনেও বুঝতে পারেননি, পরের মাসে তার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে।
এ দিকে ভালো হোক বা মন্দ হোক, আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন। যেমন সূরা আত তালাকের ৩ নম্বর আয়াতে তিনি বলেছেন- ‘আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করে রেখেছেন’। মানুষ জানে না, তার জীবনের সবকিছু নিয়তি অনুযায়ী সংঘটিত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন- ‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের ওপর যেসব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে, তাকে আমি সৃষ্টি করার আগে একটি গ্রন্থে লিখে রাখিনি। এমনটি করা আল্লাহর জন্য খুব সহজ।’ ( সূরা আল হাদিদ, আয়াত-২২)
মোদ্দা কথা, আল্লাহ তাঁর সব সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছেন। তার চাওয়া ও ইচ্ছাই চূড়ান্ত। আল্লাহ না দিলে মানুষের পক্ষে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। যেমন করে নমরুদ চেয়েছিল হজরত ইব্রাহিম আ:-কে পুড়িয়ে মারতে আর আল্লাহ চাইলেন তাকে রক্ষা করতে। তিনি আগুনকে বললেন, ‘হে আগুন তুমি ইব্রাহিমের জন্য আরামদায়ক হয়ে যাও’ - আগুন তা-ই হয়ে গেল। আর মানুষের ক্ষমতা ততটুকু যতটুকু আল্লাহ দিয়ে থাকেন। পৃথিবীতে যত জালিম শাসক এসেছে তারা সবাই তাদের নিয়তি নির্ধারিত পথ ধরে এসেছে। নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত অত্যাচার চালিয়েছে। অতঃপর তাদের নিয়তি নির্ধারিত সময়সীমা পার হতেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহ খুব কঠোর। তিনি বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ জুলুমের কাজে জড়িত, তাকে আমি গুরুতর শাস্তি আস্বাদন করাব।’ (সূরা ফুরকান, আয়াত-১৯)
অন্য আরেক আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আর যারা জালিম তাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা শুরা-৮) জালিমদের পতন ঘটলে দলবলসহ পতন ঘটে। যেমন কুরআনুল কারিমে আল্লাহ আদ, সামুদ কিংবা নমরুদ ও ফেরাউনদের ধ্বংসের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে- তারা তাদের অনুসারী দলবল নিয়ে ধ্বংস হয়েছিল। বর্তমান যুগেও একইভাবে জালিমদের পতনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে একবিংশের শুরুতেই আমরা ইরানের রেজাশাহ পাহলভি এবং ফিলিপাইনের মার্কোসসহ অনেক নীপিড়ক শাসককে দেখেছি, যাদের পতন ঘটেছে দলবলসহ।
পবিত্র কুরআনে জালিমদের শাস্তি সম্পর্কে নানাভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন- ‘তাদের কারো প্রতি আমি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পাকড়াও করেছে বিরাট আওয়াজ, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূ-গর্ভে, কাউকে করেছি পানিতে নিমজ্জিত। আল্লাহ এমন নন যে, তাদের ওপর জুলুম করবেন; বরং তারা নিজেরা নিজেদের ওপর জুলুম করত।’ (সূরা আনকাবুত : ৩৯-৪০)
আল্লাহ জালিমদের শক্তিকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ মাকড়সার জাল সবচেয়ে দুর্বলতম জাল। অথচ মাকড়সা ভাবে, সে সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করেছে। তাই আল্লাহ বলেন- ‘তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সার মতো, যে নিজের জন্য ঘর বানায়, আর নিশ্চয় সবচেয়ে দুর্বল ঘর হলো মাকড়সার ঘর যদি তারা জানত।’ (সূরা আনকাবুত-৪১) অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম এলে জালিম শাসকের মসনদ তাসের ঘরের মতো ভেঙে খান খান হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার লৌহকঠিন শাসনের অবসান দেখে কি তা মনে হয় না?
আমরা এই সত্য উপলব্ধি করতে পারি, আসমান ও জমিনে আল্লাহই একচ্ছত্র অধিপতি। বাকি সবকিছু তাঁর সৃষ্ট ও অধীনস্থ। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। যেমনটি সূরা আল ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াতে বিধৃত হয়েছে। আয়াতটি এ রকম- ‘বলুন, হে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ, আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন, যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি অপমানিত করেন। আর কল্যাণ তো আপনার হাতে, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’