ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে ভারতের সাথে সম্পর্ক বদলাতে পারে। গত ৮ মার্চ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি ও চলমান সঙ্ঘাত থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পরিবর্তিত হতে পারে, তাই এ বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত নেয়া খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান স¤পর্ক নিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রবিন্দু একটি নির্দিষ্ট দেশ এবং সে দেশ যদি আমার কোনো প্রতিবেশীর সাথে স¤পর্ক স্থাপন করে, তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তার প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, সেই দেশের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পথ ব্যবহার করা হতে পারে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের স¤পর্ক নিয়ে সে দেশের সেনাপ্রধানের বক্তব্য কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি স¤পূর্ণভাবেই কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।
বাংলাদেশ এবং ভারত পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র, পরস্পরের প্রতিবেশী। শান্তি, অগ্রগতি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থেই দুই দেশের মধ্যে সুস¤পর্ক অপরিহার্য। কারণ প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না। ভারত কখনো বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব বুঝতে চায়নি এবং সম্মান করেনি। বরাবরই আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারকে অন্ধ সমর্থন করে গেছে। এ জন্য অগণতান্ত্রিক সব পন্থা অবলম্বন করেছে। আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের বিরোধী দলবিহীন ডামি-আমির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এসব অগণতান্ত্রিক কাজে ভারত শুধু সমর্থন নয় সরাসরি সহযোগিতা করেছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন স¤পর্কে ভারত বলেছিল, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখন বলছে, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব বিষয়ের নিষ্পত্তি চায় ভারত। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতের দ্বিমুখী নীতি প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন হয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের এসব আচরণ মেনে নেয়নি। শেখ হাসিনার সরকার সবসময় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এবং জনগণের ওপর দমন নির্যাতন চালিয়েছে।
পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের দাসত্ব করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেনি। নিজস্ব স্বকীয়তায় মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্যই বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় তারা জীবন দিতে প্রস্তুত কিন্তু কারো দাদাগিরি মানতে রাজি নয়। ভারতের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে না এবং পরাধীনতার বিনিময়ে স্বাধীনতার ঋণ শোধ করতে পারে না। ভারত কিন্তু তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে। চিরশত্র“ পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল ভারতের মূল উদ্দেশ্য। এ কথাটি প্রমাণিত সত্য। ভারত কাশ্মির, পাঞ্জাব এবং সেভেন সিস্টার্সসহ কোনো অঙ্গরাজ্যকে স্বাধীনতা দেয় না বরং সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনকে বল প্রয়োগে দমন করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এ সময়ে দেশ দু’টির নেতারা দেশ দু’টির মধ্যকার স¤পর্ককে বিশ্বে রোড মডেল হিসাবে ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু ভারত পদ্মা, তিস্তার পানি দেয়নি এবং সীমান্তে হত্যা বন্ধ করেনি। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দশ বছরে বিএসএফ সীমান্তে ৩০৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনা পরবর্তী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পরিহার করেছে। তিনি ভারতের কথামতো চলছেন না। তাই ভারত বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ এবং বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করেছে। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি এক শ্রেণীর মিডিয়া বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষমতায় কে আছে তা ভারতের দেখার বিষয় নয় এবং সে অধিকার কোনোভাবেই ভারতের নেই। এ দেশের ক্ষমতায় কে থাকবে তা এ দেশের জনগণই ঠিক করবে। ভারতের উচিত স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে সম্মান করা এবং বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করা। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান, সমমর্যাদা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক হতে হবে। বাংলাদেশকে তার ন্যায্য প্রাপ্য দিতে হবে। কিন্তু তা না করে ভারত যেসব কথা বলছে তা স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে অসম্মানের শামিল।
বাংলাদেশ সবসময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সুস¤পর্ক চায়। প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশী চিকিৎসা, ব্যবসা এবং পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যায়। প্রচুর ভারতীয়ও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের মধ্যে বিয়ে শাদীর মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলেছে। দেশ দু’টির মধ্যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে। সীমান্তে ব্যবসা বাণিজ্য স¤পাদনে একাধিক নদীবন্দর, স্থলবন্দর এবং কাস্টম হাউজ রয়েছে। অনেক সীমান্ত হাট রয়েছে। দেশ দু’টির মধ্যে বাস এবং ট্রেন চলাচল বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত এবং অভিন্ন নদী রয়েছে। কিছু হলেই ভারত বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং বাংলাদেশে আলু, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং অপরাধীদের ভারত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ফলে বাংলাদেশ সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবিলম্বে এসবের অবসান হওয়া দরকার।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক



