ভারত উপমহাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে ভৌগোলিকভাবে এক বিশাল ভূভাগ। পৃথিবীর মানচিত্রের বিরাট অংশজুড়ে ভারতবর্ষের অবস্থান। প্রাচীন আমল থেকে যুগে যুগে ভারতবর্ষে বহু দেশ ও জাতির উদ্ভব ঘটেছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেসব দেশের মধ্য থেকে অনেক দেশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। অনেক দেশ আবার ভৌগোলিকভাবে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যেনতেনভাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডের এক খণ্ডিত অংশ। আদি যুগ থেকে এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে, রক্তক্ষরণ ঘটেছে। কখনো বা সেসব যুদ্ধের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু সময়ের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করেছে আবার কিছু দিন পর সে স্বাধীনতা হারিয়েও গেছে। অতীতের বারোভূঁইয়াসহ অনেক স্বাধীনচেতা বীর বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। সে ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আমরা জানি, ব্রিটিশদের আগমনের আগে ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে মুর্শিদকুলি খান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাসহ ভারতবর্ষের এক বিশাল ভূখণ্ড। এ স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বশেষ শাসক ছিলেন নবাব সিরাজউদদৌলা। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতনের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন শাসকের হাত ঘুরে বাংলাদেশ ব্রিটিশ আমলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলা হিসেবে টিকে ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া নামক দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সে বিভক্তির জেরে তৎকালীন বাংলাদেশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বর্তমান ভূখণ্ড পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। পরে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তান নামক ভূ-খণ্ডটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। বর্তমান বাংলাদেশ আমরা যে অবস্থানে বসবাস করছি তা রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেকটাই বিপর্যস্ত। এক শ্রেণীর বোদ্ধা মনে করেন, আমাদের এই ভূখণ্ড বা দেশটির তেমন কোনো বহিঃশত্রু নেই। সে কারণে আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী পরিপোষণের কোনো যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে এ চিন্তাচেতনা অনেকটাই ভুল। বর্তমানে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে আমেরিকা ও চীন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতি পুরো পৃথিবীসহ আমেরিকাকে ভাবিয়ে তুলছে। অনেক আগে থেকেই তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে তাইওয়ান ও চীনের সাথে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে। আমেরিকা অত্যন্ত কঠিনভাবে তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চীনের সার্বিক অগ্রগতি রুখে দিয়ে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত জরুরি। সে কারণে চীন দীর্ঘদিন ধরে ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তিকে সুদৃঢ় করার চেষ্টায় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমেরিকা দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় সে ঘাঁটি যথেষ্ট নয়। সে কারণেই এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, আমেরিকা নাকি বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল সেন্টমার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার চেষ্টা করছে।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো মিলে বাংলাদেশের পুরো ভূভাগের এক-দশমাংসের সমান। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে তারা দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত। আরাকানের ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার-অবিচার চালিয়ে আসছে। সে কারণে মিয়ানমারের আরাকান থেকে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কুকি চীন নামক পার্বত্য জনগোষ্ঠী স্বাধীকার আন্দোলনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে পার্বত্য বিদ্রোহীদের হাতে অনেক নিরীহ বাঙালি শাহাদতবরণ করেছেন। এমনকি এ পার্বত্য বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পুলিশ, বিজিপি ও অনেক সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। সে কারণে বাংলাদেশের এ বিশাল ভূখণ্ডের নিরাপত্তা রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভৌগোলিকভাবে অনেক গুরুত্ব বহন করে। সে কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর অনেক বিদেশী শক্তির শ্যেনদৃষ্টি আছে। সর্বোপরি সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের উত্তরাঞ্চলের সাতটি পার্বত্য প্রদেশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পক্ষে এ সাতটি প্রদেশের সাথে ভৌগোলিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ। কারণ বাংলাদেশের উত্তরের ভূখণ্ড ও চীনের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে সীমিত পরিমাণ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে অনেক ঘুরপথ অতিক্রম করে ভারতকে এ সাতটি প্রদেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। সে কারণে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সাতটি প্রদেশে যোগাযোগ রাখার জন্য ট্রানজিট পাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। যে বিষয় নিয়ে বিগত সরকারের সাথে ভারত সরকারের বহুবার আলোচনা ও বিভিন্নমুখী চুক্তি হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেসব চুক্তির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে প্রতিবেশী দেশের সাথে আমাদের আগের মতো সুসম্পর্ক নেই। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনীর একান্ত প্রয়োজন।
আমরা জানি, যেকোনো দেশের শক্তিশালী সেনাবাহিনী সে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্যতম গ্যারান্টি। আমরা আরো জানি, আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক নেই। তদুপরি চীন ও ভারত দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশ দু’টির মধ্যে সীমান্ত যুদ্ধসহ ১৯৬২ সালে সর্বাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তার পরও দেশ দু’টির মধ্যে সীমান্ত সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। যে কারণে মাঝে মধ্যে উভয় দেশের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ লেগে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে কাশ্মির সমস্যাকে কেন্দ্র করে একাধিকবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তারপরও কাশ্মির সমস্যার স্থায়ী নিষ্পত্তি হয়নি। সিন্ধুর পানি চুক্তি নিয়েও উভয় দেশের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্তিশালী সেনাবাহিনী ব্যতীত কিভাবে সে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখবে! বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।