মো: ওবায়দুল্লাহ
ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে গাজা অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে মানবিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। ইসরাইলের সেনাবাহিনী নতুন করে গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা করায় বর্তমানে অঞ্চলটি আরো একবার বিশ্বের শীর্ষ আলোচনার কেন্দ্রে। এই পরিকল্পনাটি সম্প্রতি ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। কিন্তু এই ভয়ানক পরিকল্পনা শুধুই কেবল গাজার জনগণের জন্য একটি নতুন বিপর্যয় ডেকে আনবে তা নয়, বরং এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি, বৈশ্বিক শান্তির জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন এই সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে এবং ইসরাইলকে তার ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ অবিলম্বে বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে।
চীনের অবস্থান : দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান এবং গাজার মানবিক সঙ্কট
চীন গাজার দখল এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সঙ্ঘাতের অবসান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুয়া জিয়াকুন বলেছেন, ‘গাজা ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার, এটি ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ চীন মনে করে যে, গাজার সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান শুধুমাত্র একটি ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’-এর মাধ্যমে সম্ভব। ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, যেখানে তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে রক্ষিত হবে। এই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গাজার পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার ৫০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬০ শতাংশ শিশুর মধ্যে পুষ্টির অভাব রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধ এবং সঙ্ঘাতের কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই সঙ্কটের ফলে গাজার জনগণের জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরাইলের অবজ্ঞা
চীন গাজার দখল এবং যুদ্ধের ফলে ইসরাইলের আচরণকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করছে। আন্তর্জাতিক আদালত ইতোমধ্যে ইসরাইলকে গাজার দখল অভিযান অবিলম্বে শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তবে ইসরাইল এই নির্দেশ উপেক্ষা করে তার আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন মনে করে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এটি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত, এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা। গাজার জনগণের জীবনযাত্রা শুধু তাদের মানবিক অধিকার রক্ষা করা নয়, বরং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন জানিয়েছে, গাজার সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে যুদ্ধবিরতি এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান, যেখানে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং ইসরাইল নিরাপদে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে।
চীনের উদ্যোগ : ফিলিস্তিনিদের ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সমাধান
চীন শুধু গাজার দখল বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে না, বরং এটি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করছে। চীন স¤প্রতি ১৪টি ফিলিস্তিনি গ্রুপকে একত্রিত করার জন্য একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, চীন ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোকে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য আলোচনা শুরু করেছিল। চীন বিশ্বাস করে যে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হলে, তাদের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে। এছাড়া, চীন ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য পদ গ্রহণের জন্যও চাপ সৃষ্টি করছে, যা তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ইসরাইলের একক সিদ্ধান্ত
গাজা সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের অবস্থান শুধু একক নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেশ এই বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বেশ কিছু আরব দেশ ইতোমধ্যে ইসরাইলের এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী হিসেবে ঘোষণা করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরাইলের এই পদক্ষেপটি ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করা উচিত।
তবে, আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ইসরাইল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত ইসরাইলের পক্ষ নিলেও এবার কিছুটা দ্বিধায় আছে এবং তাদের যুদ্ধ কৌশল নিয়ে ভিন্ন মত জানিয়েছে। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা কেবল চীনের একক উদ্যোগ নয়, অনেক রাষ্ট্র এর সাথে আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, এই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে একযোগে কাজ করা।
লেখক : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ঢাকার ভিজিটিং স্কলার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষারত