তেহরানে বায়ুদূষণ, বিপুল ক্ষতি

ঢাকা আর তেহরান দুটো শহরের ইতিহাস বহন করে মসজিদের আঙিনায় দীর্ঘ প্রার্থনা, কবির ছন্দ, রাস্তায় মানুষের চায়ের আড্ডা আর জীবনের দৃঢ়তা। কিন্তু এখন এই দুটো শহরই প্রতিদিন এমন এক যুদ্ধে লড়ছে যার অস্ত্র নেই, সৈন্য নেই, শুধু আছে অদৃশ্য বিষ আর হাঁপাতে থাকা লাখো মানুষ

আমাদের রাজধানী ঢাকা আর ইরানের তেহরান- দুই নগরীই আটকে পড়েছে এক অদৃশ্য শত্রুর হাতে। সেটি বায়ুদূষণ। এ এমন এক শত্রু যা মানুষের শরীর-মন আর জীবনের ভবিষ্যৎকেও ছাই করে দিচ্ছে। ঢাকায় অসহায় মানুষ কাশি আর ধুলোর সাথে বসবাস শিখে নিয়েছে। আর তেহরানে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়েছে। মন্ত্রণালয় হিসাব দিয়েছে, দেশটিতে বায়ুদূষণে বছরে মৃত্যু আর অসুস্থতার আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার।

এই ঘোষণার পর নতুন করে আবার সামনে এসেছে ইরানে বহুবার পাস হওয়া; কিন্তু অর্ধেক ঘুমিয়ে থাকা নির্মল বায়ু আইন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মনে করেন, দূষণের স্থায়ী সমাধান এই আইনই দিতে পারে। এদিকে, ইরানের সংসদ গবেষণা কেন্দ্র ঠান্ডা গলায় বলে দিয়েছে, দেশে এই আইনের বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। তেহরান এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরের অন্যতম। এই খবরটি প্রথম জানায় তাসনিম নিউজ এজেন্সি। কয়েক দিনের মধ্যে এই একটি বাক্য যেন মানুষের গলায় কাঁটার মতো বিঁধে গেছে। কেউ অবাক হয়েছেন, কেউ ক্ষুব্ধ। কেউ দম বন্ধ করে তাকিয়ে থেকেছে ধোঁয়াটে আকাশের দিকে। সাম্প্রতিক দূষণের ঢেউ সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের ওপর। সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিয়েও দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ। তেহরান প্রদেশের জরুরি বিভাগ জানিয়েছে, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে জরুরি চিকিৎসা দরকার এমন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এটি এমন এক সতর্কসঙ্কেত যা বলে দেয়, দূষণের তীব্রতা কতটা গুরুতর।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আলিরেজা রাইসি বললেন, এই ভয়াবহ দূষণ আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের ফল এবং এ জন্য তাদের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তার মতে, দূষণের মাত্রা এতটাই স্পষ্ট ও মারাত্মক যে, আলাদা করে দূষণ পরিমাপের দরকার নেই। চোখে চুলকানি, গলায় জ্বালা আর কফ-কাশিতে ভরা রাস্তাঘাটই পরীক্ষার বাস্তব ফল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ইরানে প্রতি বছর প্রায় ৫৮ হাজার মানুষের মৃত্যু সরাসরি বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত। এ থেকে বোঝা যায়, দেশটি কত বড় আর ব্যয়বহুল এক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রাইসি জানান, শুধু স্বাস্থ্য খাতে বায়ুদূষণের আর্থিক ক্ষতি ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি যা দেশের পুরো স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়েও বেশি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরেকটি সংবেদনশীল জায়গায় আঙুল তুলেছে, কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছে দেশীয় গাড়ি-শিল্পের। রাইসি বলেছেন, দূষণের জন্য পুরনো জীর্ণ গাড়িগুলো যেমন দায়ী, তেমনি নতুন অনেক দেশীয় গাড়িও সমস্যা বাড়াচ্ছে। তার ভাষায়, সমস্যা শুধু পুরনো গাড়ি নয় নতুন মডেলেরও জ্বালানি খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। অনেক দেশ ইতোমধ্যেই পেট্রলচালিত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে এনেছে, কেউ কেউ পুরোপুরি বিদায়ও জানিয়েছে। যেমন- সাংহাই, যেটি একসময় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরগুলোর অন্যতম ছিল, সেই নগরী এখন আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

রাইসি অনেকটা রসিকতার সুরে বলেন, ইচ্ছে হলে গাড়ি নির্মাতারা এই মানের গাড়ি বানাতে বানাতে কারখানা গুটিয়ে নিক। চীন থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি বাদ দিয়ে সরাসরি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি করুক। তার পরামর্শ খুব স্পষ্ট, নিম্নমানের গাড়ি তৈরি বন্ধ করা হোক। সেগুলো শুধু দুর্ঘটনায় মানুষ মারছে না, বাতাসে বিষ ছড়িয়েও মারছে।

আবার শাহিদ বেহেশতি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্বাস শাহসুনি তেহরানের পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা এক বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি জানান, এবার সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর জন্য বাতাস অস্বাস্থ্যকর- এমন দিনের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর এমন দিনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। বিস্তারিত হিসাবে তিনি বলেন, স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর ২৮ শতাংশ, হৃদরোগে মৃত্যুর ৩০ শতাংশ, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগে মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ, ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুর ২৪ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুর ২০ শতাংশই বায়ুদূষণের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু শহরের গলি ঘুপচি আর বাসের ভেতরে মাস্ক পরা মানুষের কাশির সাথে পরিসংখ্যানগুলো মেলালে বোঝা যায়, এই পরিসংখ্যান আসলে ফুসফুসের হাঁসফাঁসের অনুবাদ।

অদ্ভুত সিদ্ধান্তের নাটকও কম নয়। অনেক বড় শহরে স্কুল বন্ধ রাখা না রাখা নির্ভর করে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ওপর। সেখানে তেহরানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর পরামর্শ, যদি জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয় এবং পরিবেশ দফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দু’টিই দূষণের কারণে স্কুল বন্ধের পক্ষে মত দেয়, তবে রাজধানীতেও যেন সেটি কার্যকর হয়।

এই সব টানাপড়েনের মধ্যেও স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী জানিয়েছেন, মূল সমাধান একটিই- নির্মল বায়ু আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন।

দূষণ কমানোর লক্ষ্যে ইরানের ইসলামী পরামর্শ পরিষদ ২০১৭ সালে এই বায়ু আইন পাস করে। এ আইন বাস্তবায়নে মোট ৫৬টি করণীয় নির্ধারিত আছে। কাগজে-কলমে খুব শক্ত আর পূর্ণাঙ্গ মনে হলেও সংসদ গবেষণা কেন্দ্রের সা¤প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এই ৫৬টি ধাপের মধ্যে মাত্র ১৭টি ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ১২টি ধাপ খুব দুর্বলভাবে এবং আরো ১৭টি মাঝারি মানে বাস্তবায়িত হয়েছে। সামগ্রিক চিত্রে দাঁড়াচ্ছে, দেশে এই আইন প্রয়োগ হয়েছে মোটের ওপর মাত্র ৩০ শতাংশ। সংসদীয় গবেষক রেজাই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সোজা ভাষায় বললেন, নির্মল বায়ু আইন ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগত বিধিমালার পুরোটার বদলে কার্যকর হয়েছে কেবল ৩০ শতাংশ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন বাকি ৭০ শতাংশ কাগজেই রয়ে গেছে। ইরানের মজলিশে শূরার গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিবেদনে কারণগুলোও তালিকা করে দেয়া হয়েছে। প্রথমত অর্থের অভাব। আর্থিক কারণে অনেক উদ্যোগ শুরুই হয় না। দ্বিতীয়ত, নীতি-নির্ধারকদের অগ্রাধিকারের তালিকায় বায়ুদূষণ কখনোই শীর্ষে ওঠে না। বড় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ইস্যু এলে দূষণ প্রসঙ্গ আলোচনার তালিকা থেকে সরে যায়। তৃতীয়ত, পর্যাপ্ত ও কার্যকর তদারকি নেই। চতুর্থত, বিভিন্ন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। পঞ্চমত, আইনের ধারাগুলো কখনো ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের সুবিধামতো আইনের লেখা বুঝে নেয়। সবচেয়ে বড় কারণ- আইনের ভাষাতেই কিছু ফাঁকফোকর আছে যা ব্যবহার করে দায়িত্ব এড়ানো সহজ। এই সব অজুহাতের কথাই যখন বলা হচ্ছে, তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যক্ষতির যে বিপুল আর্থিক মূল্যের কথা জানিয়েছে; তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে- দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেন এমন একটি বাজেট জোগাড় করতে পারছেন না, যা এই ক্ষতির অঙ্কের তুলনায় অনেক ছোট!

সংসদ গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বায়ুদূষণকে নীতি-নির্ধারকদের অগ্রাধিকার তালিকার উপরে তোলা গেলেই কেবল প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ইচ্ছা আর আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত হতে পারে।

বাস্তবতা হলো- বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরস্পরের সাথে যথেষ্ট যোগাযোগ ও সমন্বয় না রাখায় আইনের কিছু ধারা কাগজেই লেখা থেকে যায়। বাস্তবে কার্যকর হয় না।

বারবার জরুরি বৈঠক ডেকে সমস্যার সমাধান হবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সবচেয়ে জরুরি হলো- পুরো শক্তি দিয়ে নির্মল বায়ু আইন বাস্তবে কার্যকর করা, যাতে দূষণের প্রভাব মানুষের শরীরে আরেকটি মহামারী হয়ে ছড়িয়ে না পড়ে। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার সময় মানুষকে যেন অন্তত এমনটি ভাবতে না হয়, প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সে নিজের আয়ু খানিকটা কমিয়ে দিচ্ছে।

তেহরানের এই গুরুতর সমস্যা নিয়ে শিক্ষাজগৎ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ দফতর- সবাই যার যার মতামত দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের কারো কাছে এসব ক্ষতির হিসাব খুব বড় অঙ্কের এলজেবরা মনে হতে পারে; কিন্তু ফুসফুস ভরে ধোঁয়াশা টেনে নিয়ে যখন তারা রাতে ঘুমাতে যায় তখন হয়তো একটিই সরল কথা মনে পড়ে, বিশুদ্ধ বাতাস কোনো বিলাসপণ্য নয়, এটি একটি সমাজের ন্যূনতম অধিকার। আর সেই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা আর সাহস যতদিন না জাগে, ততদিন তেহরানের আকাশে কালো ধোঁয়া আর মানুষের গলায় আটকে থাকা কাশি- দুটোই একসাথে ভেসে বেড়াবে।

ঢাকা আর তেহরান দুটো শহরের ইতিহাস বহন করে মসজিদের আঙিনায় দীর্ঘ প্রার্থনা, কবির ছন্দ, রাস্তায় মানুষের চায়ের আড্ডা আর জীবনের দৃঢ়তা। কিন্তু এখন এই দুটো শহরই প্রতিদিন এমন এক যুদ্ধে লড়ছে যার অস্ত্র নেই, সৈন্য নেই, শুধু আছে অদৃশ্য বিষ আর হাঁপাতে থাকা লাখো মানুষ।

তেহরানে তবু ক্ষতির হিসাব আছে; ঢাকায় সেই হিসাব নেই। কেউ গোনে না। সেখানে আইন আছে কিন্তু ঘুমিয়ে আছে, এখানে আইন আছে কি না সেটিই প্রশ্ন। তবে এই দুই শহরের মানুষের হয়তো এখন একই অনুভ‚তি- প্রতিদিনের সকাল মানেই সূর্য নয়; বরং মাস্ক, ধুলা, কাশি আর নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য আরেক রাউন্ড লড়াই।

তবুও শহর দুটো বেঁচে আছে, কারণ শহর মানে কেবল ভবন নয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি আর প্রতিদিন নতুন করে শুরু করার এক অদম্য জেদ। দুটো শহরেরই অপেক্ষা সেই শুভদিনের যখন শ্বাস নেয়া আর ভীতিকর নয়; বরং সহজ এক মানবিক অধিকার হবে।