বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি বিদ্যমান। বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং একই সাথে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। যদিও বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, কিন্তু ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধের চাপ ভবিষ্যতে বাড়তে পারে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা, দুর্বল অবকাঠামো, দুর্নীতি, উচ্চ করহার, অর্থায়নের অভাব এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ও বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগে পিছিয়ে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি প্রত্যাশা করা হয় তার বিপরীতে বিদেশী বিনিয়োগের হার অপর্যাপ্ত। বিদেশী বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশ ভালো করছে না। যে বিনিয়োগ আসছে, তা মূলত দেশে ব্যবসারত বিদেশী কোম্পানিগুলোই করছে। নতুন কোম্পানি কম আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ব্যবসায় পরিবেশ তথা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে। এগুলো হলো- বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার। জাতিসঙ্ঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে কোন দেশ কত বিদেশী বিনিয়োগ পায়, তা তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির ২০২৪ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে। অন্য দিকে ভারত দুই হাজার ৮১৬ কোটি, ভিয়েতনাম এক হাজার ৮৫০ কোটি, ইন্দোনেশিয়া দুই হাজার ১৬৩ কোটি, কম্বোডিয়া ৩৯৬ কোটি ও পাকিস্তান ১৮২ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ পায়। বাংলাদেশে আসা বিদেশী বিনিয়োগ সব সময়ই প্রত্যাশার চেয়ে কম বলে গণ্য করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে রিজার্ভ তুলনামূলক স্থিতিশীল এবং ডলারের বিনিময় হারও আগের মতো অস্থির নয়। ফলে বিদেশী ঋণ গ্রহণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে।
এ দিকে দেশে উচ্চ নীতি সুদের (১০ শতাংশ) প্রভাবে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গত এপ্রিলের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৭.৫০ শতাংশে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম নিচু অবস্থান।
টেকসই বিনিয়োগ এবং উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হলে সুদের ভারসাম্য রক্ষা, মুদ্রানীতি বাস্তবমুখী করা এবং বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী জিডিপির হার ও রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। ফলে বৈদেশিক ঋণ অর্থনীতিতে অনেকটা ঝুঁকি তৈরি করছে। চাপ বাড়ছে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। গত দেড় দশকে অর্থনীতিতে নানাভাবে চাপ বাড়িয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। দেশী-বিদেশী ঋণ বাড়িয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ঋণের বড় অংশই নানা কেনাকাটার নামে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এতে বেড়েছে সুদব্যয় ও ঋণ পরিশোধের চাপ। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে সরকারের দেশী-বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ কোটি টাকায়। সেই হিসাবে আগামী বছর ঘোষিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচিত সরকারের কাঁধে শুরুতেই বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা চাপবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের দেশী-বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে দেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা; আর বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০ লাখ ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত তিন বছর মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিবৃতিতে অর্থ বিভাগ প্রাক্কলন করেছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ লাখ তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। তার পরের বছর শেষে ঋণ ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থ বিভাগের নীতি-বিবৃতির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের জন্য ঋণে স্থিতি প্রাক্কলন করা হয় ২২ লাখ তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা সংশোধন করে ২১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক বক্তৃতায় বলেছেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখন পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। এ পর্যন্ত বৈদেশিক ও সামগ্রিক ঋণ ‘নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থানে রয়েছে। তবে বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া চাপের কারণে আরো ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। এদিকে সদ্য প্রকাশিত সরকারের মধ্যমেয়াদি (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৬-২৭) ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পরিমাণ বেশি হওয়ায় নিম্ন থেকে প্রায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, বৈদেশিক ঋণ সব সময় দেশের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। এ জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের আগে সুবিধা-অসুবিধা মূল্যায়ন করে এগোতে হবে। কারণ : ১. বৈদেশিক ঋণ দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি ঋণের শর্তাবলি কঠিন হয় বা সুদ বেশি হয়।
২. ঋণ পরিশোধের জন্য বাংলাদেশকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত হতে পারত।
৩. যদি দেশটি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হতে পারে এবং ভবিষ্যতে ঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে।
৪. বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হলে, তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন প্রভাব ফেলে না। আর বিদেশী বিনিয়োগ যেখানে একটি বড় অংশ ঋণ আকারে আসে, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা সহজে নিয়ে যেতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি থেকে পুঁজি স্থানান্তরের ঝুঁকি তৈরি করে। কিছু ক্ষেত্রে, বিদেশী বিনিয়োগ স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যদি তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে।
কিছু বিদেশী বিনিয়োগ টেকসই নাও হতে পারে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক ঋণের ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে, কিন্তু একই সাথে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে তবে তা যেন দেশের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে হয়। অন্য দিকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও হিসাব করে নিতে হবে যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ অগ্রগতি যেন বাধার সম্মুখীন না হয়।
লেখক : ব্যাংকার