ডাকসু ও জাকসুর ফলাফলে ছাত্রীদের ভূমিকা

ডাকসু ও জাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয় শুধু নারী শিক্ষার্থীদের ভোটব্যাংকের সাফল্য নয়, এটি ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন ধারা সূচিত করেছে। সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির রাজনীতিকে পেছনে ফেলে শিক্ষার্থীরা এখন এমন নেতৃত্ব চাইছে, যারা তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে সৎ, যোগ্য ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা রাখবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-জাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচন ছাত্ররাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের বিজয় শুধু একটি সংগঠনের জয় নয়; বরং জুলাই চব্বিশের গণ-আন্দোলনে প্রাণ হারানো শহীদদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই ফলাফল নতুন প্রজন্মের, বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের ভোটে আস্থার এক নতুন ধারাও তৈরি করেছে।

নারীবিদ্বেষী ট্যাগ ব্যর্থ : দীর্ঘ দিন ধরে শিবিরকে ‘নারীবিদ্বেষী’ সংগঠন হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা হয়েছে। এই নির্বাচন সেই অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। যে কেন্দ্রগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের ভোট বেশি, সেখানে শিবিরের প্রার্থীরাই এগিয়ে থেকেছেন। শিবিরপন্থী ছাত্রীনেত্রী সাবিকুন্নাহার তামান্নার হিজাব পরা ছবি বিকৃত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভের ঝড় ওঠে। অনেক ছাত্রী এই ঘটনাকে ‘পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতার প্রতি বিদ্বেষী মানসিকতা’ হিসেবে দেখেছেন এবং প্রতিক্রিয়ায় সহানুভ‚তি চলে গেছে শিবিরের দিকে।

ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা : ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের ভ‚মিধস বিজয় প্রমাণ করেছে- শিক্ষার্থীরা আর সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি বা দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চায় না। তারা নিরাপদ, শিক্ষা-বান্ধব পরিবেশ, স্বচ্ছ নির্বাচন ও মেধাভিত্তিক সুস্থ রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল। শিবির তার প্রার্থীদের ক্লিন ইমেজ, যুগোপযোগী কর্মসূচি এবং সুসংগঠিত প্রচারণার মাধ্যমে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে।

মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা : মনোবিজ্ঞানের ‘অসঙ্গতি তত্ত্ব’ বলছে যা নিষিদ্ধ বা নিন্দিত হয়, তা অনেকসময় মানুষের কৌত‚হল বাড়িয়ে দেয়। শিবিরকে নিয়ে বছরের পর বছর নেতিবাচক প্রচার ও নিষেধাজ্ঞা অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে উল্টো দিকের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ কৌত‚হলবশত তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, কেউবা সরাসরি সহানুভ‚তিশীল হয়ে উঠেছে।

নারীদের ভোটব্যাংক : শিবির নারী শিক্ষার্থীদের ভোট নিয়ে চিন্তিত ছিল। অথচ এ নারী শিক্ষার্থীদের নিজেদের পক্ষে আনার কৌশলই শিবিরের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। দুটো বিশ্ববিদ্যালয়েই নারী ভোটারদের বড় অংশ শিবিরের প্যানেলকে সমর্থন করেছে। একাধিক নারী শিক্ষার্থী বলেন, শিবিরের রাজনীতি পছন্দ না করলেও প্যানেলের প্রার্থীদের তারা বিশ্বাস করেন। ঢাবির বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল ও শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভিন্ন রকম চোখে দেখছেন।

এই নির্বাচনে নারী ভোটারদের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। রোকেয়া হলের উদাহরণ দিলে দেখা যায়, ভিপি পদে শিবিরের প্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন এক হাজার ২৭০ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৫৪৭ ভোট। ছাত্রদলের প্রার্থী পেয়েছেন ৪২৩ ভোট। জিএস পদে শিবিরের প্রার্থী এস এম ফরহাদ পান ৯৬৪ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের মেঘমল্লার বসু পান ৫০৭ ভোট। ছাত্রদলের প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৪০২ ভোট। অন্য কেন্দ্রগুলোতেও অনেকটা এমন চিত্রই দেখা যায়।

শিবির নারীদের কাছে পৌঁছেছে কয়েকটি উপায়ে : প্রার্থীদের নম্র ও শালীন আচরণ; নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতিশ্রুতি; ইসলামী ছাত্রী সংস্থার হলভিত্তিক সক্রিয় প্রচারণা; ছাত্রীদের প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেয়া; হিজাব-নিকাবসহ বিভিন্ন পোশাকধারী নারী প্রার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করা। এই পদক্ষেপগুলো ছাত্রীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে এবং ‘পর্দা নারীর অগ্রগতিতে বাধা নয়’ এমন বার্তাও দিয়েছে।

নির্বাচনী কৌশল : শিবিরের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছে, ক্লিন ইমেজ, সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থাপনা, ডোর-টু-ডোর ক্যাম্পেইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা, মেধাবী প্রার্থী নির্বাচন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো ছাত্রদের কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।

শিবিরের আরো কিছু সৃজনশীল কৌশল ছিল : নারী ও সংখ্যালঘু প্রার্থীকে প্যানেলে স্থান দেয়া; ক্যাম্পাসে মেধাবী ও নির্দলীয় ইমেজধারী শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা; কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ও ভর্তি-সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে আগে থেকেই নেটওয়ার্ক তৈরি করা।

প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা : শিবিরের প্যানেলে প্রার্থী বাছাই হয়েছে যোগ্যতা, সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। সাদিক কায়েম, যিনি ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন, জুলাই আন্দোলনের পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মপ্রচারহীন ও বিতর্কমুক্ত চরিত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্যক্তিগত সততা ও সহজ-সরল আচার-আচরণের কারণে শিক্ষার্থীরা তাকে ‘রাজনৈতিক নেতা’ নয়; বরং ‘নিজেদের মতো একজন ছাত্র’ হিসেবে দেখেছেন।

সাংগঠনিক ভিত্তি : দীর্ঘ দিন প্রায় নিষিদ্ধ থাকার পরও শিবির ক্যাম্পাসে ভেতরে ভেতরে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। মেডিক্যাল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং এবং কৃতী ছাত্রছাত্রী সংবর্ধনার মাধ্যমে তারা একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এই ভিত্তি নির্বাচনকালে কাজে লেগেছে।

মধ্যপন্থার নীতি : শিবির নির্বাচনে উন্মুক্ততার নীতি অনুসরণ করেছে। তাদের দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। এ কারণে চাকমা সম্প্রদায়ের প্রার্থীও তাদের প্যানেল থেকে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন, আবার হিজাব না পরা নারী শিক্ষার্থীও মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক সম্পাদক পদে বিজয়ী হয়েছেন। এটি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘এক্সক্লুসিভ’ নয়; বরং ‘ইনক্লুসিভ’ ইমেজ দিয়েছে।

অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে- শিবির প্যানেল থেকে নির্বাচিত চাকমা সম্প্রদায়ের সর্ব মিত্রকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি তো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের, আপনি শিবির প্যানেল থেকে কিভাবে দাঁড়ালেন? উত্তরে সে বলেছে, আমি শিবির করি না; কিন্তু আমি ওদের সম্পর্কে অনেক খারাপ কিছু শুনেছি। তাই ভেতরে থেকে দেখতে চাই, আসলেই এরা কেমন। যেটি সে বলেছে, সেটি হচ্ছে- ‘আমি এক্সপ্লোর করতে চাই’। ওদের সাথে প্রাথমিকভাবে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। এবার দেখি- সত্যি সত্যিই এরা ভালো কি না। আবার জুমা নামের যে ছাত্রীটি মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছে সে ছাত্রী সংস্থার মতো হিজাব পরে না অথচ শিবির প্যানেল থেকে দাঁড়িয়েছে এবং জয়ী হয়েছে। এটি শিবিরের একটি বড় কৌশল ছিল, সবার ভোট কাছে টানার।

নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ : নারী সহিংসতার ঘটনার পর শিবির নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রার্থীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সততা ও নৈতিকতা ছাত্রীদের কাছে বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রীদের বিভিন্ন ফোরামে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে, যা তাদের আস্থা বাড়িয়েছে।

পরিবর্তনের ইঙ্গিত : ডাকসু ও জাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয় শুধু নারী শিক্ষার্থীদের ভোটব্যাংকের সাফল্য নয়, এটি ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন ধারা সূচিত করেছে। সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির রাজনীতিকে পেছনে ফেলে শিক্ষার্থীরা এখন এমন নেতৃত্ব চাইছে, যারা তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে সৎ, যোগ্য ও জবাবদিহিমূলক ভ‚মিকা রাখবে।

নতুন প্রজন্মের এই ভোটাভ্যাস জাতীয় রাজনীতির জন্যও এক নতুন বার্তা বহন করছে যে, কোনো নেতিবাচক ট্যাগ আর কার্যকর হচ্ছে না। মেধা, সততা, অন্তর্ভুক্তি ও আস্থাই এখন ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের মূল মাপকাঠি।

লেখক : নির্বাহী সদস্য, লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ