বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে এসএমই খাত

দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলার অভাব ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সার্বিকভাবে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেকারত্বও বেড়েছে। বেড়েছিল মূল্যস্ফীতি। তাই অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা ও বেকারত্ব কমাতে সিএমএসএমই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বিকল্প নেই। এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। শিল্প খাতের উন্নয়নেও সিএসএমই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ খাতের উন্নয়নে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। কেউ একজন চাইলে দক্ষ উদ্যোক্তা হতে পারেন না। এ জন্য তাকে বেশ কিছু গুণাবলি অর্জন করতে হয়, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়, দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ এসএমই শিল্প অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এবং অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করে। এসব খাতের উদ্যোক্তাদের আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসা দরকার। সরকারের যেসব সেবামূলক কারিগরি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, এসএমই উদ্যোক্তারা সেখান থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের হার বেড়ে ৮.০১ শতাংশ হয়েছে (২০২২ সালের পিপিপি ভিত্তিতে)। এসএমই খাতের প্রতি নজর না দিলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য আরো বেড়ে যেতে পারে। এদিকে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা অর্জন থেকে এখনো দূরে রয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে এসএমই উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা দিতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তার সুপ্ত সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা সম্ভব। এসএমই সেক্টরের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। সরকার এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ করলে ও বিভিন্ন সময়ে জবাবদিহির অভাবে তা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ইদানীং এমএমই উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে এসএমই উদ্যোক্তারা তাদের বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন।

টেকনোলজি ট্রান্সফার এসএমই খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের বেশির ভাগ এসএমই উদ্যোক্তা এখনো সনাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনকার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা পুরোমাত্রায় কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। এখন অনেক এসএমই উদ্যোক্তা ধীরে ধীরে প্রযুক্তির সাথে পরিচিত এবং ব্যবহারে উদ্যোগী হচ্ছেন।

এসএমই খাতে নতুন নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। তবে এসএমই উদ্যোক্তাদের যে ঋণ দেয়া হচ্ছে, তার পরিমাণ খুব কম। অথচ এ খাত থেকে ঋণের আদায়ের হার অত্যন্ত ভালো। অথচ বড় বড় অনেক ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণের অর্থ ফেরত দেন না, যার ফলে ক্লাসিফায়েড বিনিয়োগ অনেক বেড়ে যায়। যার জন্য ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে অত্যন্ত তৎপর। আগে কটেজ এবং মাইক্রো শিল্প এসএমই সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল না। ফলে কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন পেতে সমস্যা হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক বছর আগে এসএমই সেক্টরের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পকে এসএমই খাতের আওতাভুক্ত করে এ খাতের নতুন নামকরণ করেছে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ বা অর্থায়ন পাওয়ায় বিরাজমান সমস্যা দূর হয়েছে।

সিএমএসএমই খাতে বিনিয়োগ : ২০২৪ সালের কিছু সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনসহ নানা অস্থিরতায় বছরটি অতিবাহিত হয়। তাছাড়া ব্যাংক খাতে তারল্য প্রবাহও কম ছিল। এসবের প্রভাবে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ঋণ বিতরণ কাক্সিক্ষত মানের হয়নি। করোনার পর গত বছর বিতরণ কমেছে। ২০২৪ সালে সিএমএসএমইতে বিতরণ হয়েছে মোট দুই লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় যা ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বা সাড়ে ৬ শতাংশ কম।

আমরা জানি, ছোট ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে কম খরচে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। যে কারণে উন্নয়নশীল দেশে সব সময় এসব খাতে বিতরণে জোর দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেশ আগে থেকে এ খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে এসএমই খাতে বিনা জামানতে নারীদের জন্য ২৫ লাখ টাকা এবং অন্য ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে বলা হয়েছে। করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই- এ ধরনের ব্যবসায়ীর অন্য ব্যবসায়-সংক্রান্ত সনদ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সাল-পরবর্তী সময়ে নানা কারণে হয়তো ঋণ বিতরণ কমেছে। কেননা, যেকোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগের হার কম থাকে। এ জন্য বেসরকারি খাতের সার্বিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সাধারণভাবে সব সময় সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ বেড়ে থাকে। তবে গত বছর কমেছে। এর আগে করোনার মধ্যে লকডাউনে বেশির ভাগ কাজে স্থবিরতা ছিল। ফলে ২০২০ সালে ঋণ বিতরণ কমে যায়। ওই বছর বিতরণ নেমে ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকায়। আগের বছর ২০১৯ সালে যেখানে বিতরণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এর মানে, এক বছরে বিতরণ কমে ১৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে সিএমএসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১৩ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএমএসএমইতে মোট দুই লাখ ২৯ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। ২০২২ সালে বিতরণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ২০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল আট হাজার ৮২৩ কোটি টাকা; যা ৪ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে এ খাতে ঋণ বেড়েছিল ৩৫ হাজার ৬১ কোটি টাকা বা প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০২১ সালে সিএমএসএমইতে মোট বিতরণ হয়েছিল এক লাখ ৮৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় যা বেশি ছিল ৩২ হাজার ৩২ কোটি টাকা বা প্রায় ২১ শতাংশ।

দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলার অভাব ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সার্বিকভাবে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেকারত্বও বেড়েছে। বেড়েছিল মূল্যস্ফীতি। তাই অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা ও বেকারত্ব কমাতে সিএমএসএমই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বেকারত্ব নিরসনে সিএমএসএমই : বেকারত্ব নিরসনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য খাতটি একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি। এ খাতে বিনিয়োগে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সিএমএসএমই খাত শ্রম-নিবিড় হওয়ায় এটি বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান করতে পারে, বিশেষত যুবক ও নারীদের জন্য। বাংলাদেশে ৭০-৮০ শতাংশ অ-কৃষি কর্মসংস্থান এ খাত থেকে সৃষ্টি হয়।

অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি : ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন- গ্রামীণ মহিলা ও স্বল্পশিক্ষিত যুবক, আয়-সৃষ্টিমূলক কাজে যুক্ত হতে পারে।

স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন : সিএমএসএমই স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদন করে, যা স্থানীয় বাজার ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করে।

রফতানি বৃদ্ধি : হস্তশিল্প, হোম টেক্সটাইল, কৃষিজাত পণ্য, লেদার গুডস ইত্যাদি রফতানিতে এসএমই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সামাজিক স্থিতিশীলতা : বেকারত্ব কমলে অপরাধ ও সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পায়। বেকারত্ব কমাতে সিএসএমই খাতে বিনিয়োগ একটি টেকসই সমাধান, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। সরকার, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাতের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
[email protected]