অসহ্য বর্জ্য‌ই হতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎস

কিছু কিছু স্থান আছে এমন, নির্মল বায়ু তো দূরের কথা জানালা দিয়ে বাতাস আসলে দূর্গন্ধে ঘরে থাকা যায় না।

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

স্বাচ্ছন্দ্য ময় পরিপাটি বাসস্থান কে না চায়। রাজধানী ঢাকা শহরে জনসংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে দূষণ। দূষণের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে বাহক বাহিত রোগসমূহ।

এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬,৫০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এই বিশাল বর্জ্য পদার্থের অপসারণ কতটা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৫৫% বর্জ্য প্রতিদিন অপসারণের বাইরে থেকে যায়। যা যন্ত্রতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। অতিষ্ঠ করে তুলেছে নগর জীবনকে। দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে চলেছে মশা মাছি বাহিত রোগ-জীবানুর। কেড়ে নিচ্ছে অত্যন্ত মূল্যবান প্রাণ। অর্থ খোয়াচ্ছেন আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ।

একবার যদি একটু সুস্থ মাথায় চিন্তা করি, প্রতিদিনের ৫৫% বর্জ্য যদি স্তূপিকৃত হতেই থাকে তাহলে পুরো শহরটা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হতে কত সময় আর বাঁকী। তাইতো ঢাকা শহরের কোনো রাস্তায় একজন মানুষ স্রেফ ৫ মিনিটের জন্য নাকে হাত বা অন্য কিছু দিয়ে না ঢেকে উন্মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন না। এমন বেহাল অবস্থা।

কিছু কিছু স্থান আছে এমন, নির্মল বায়ু তো দূরের কথা জানালা দিয়ে বাতাস আসলে দূর্গন্ধে ঘরে থাকা যায় না।

উদাহরণ হিসাবে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পশ্চিম দিকের যে খালটি রয়েছে তার কথা একবার ভাবুন। খালের উপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাস যখন পার্শ্ববর্তী বাসায় প্রবেশ করে তখন কি বাসিন্দারা শান্তি বা স্বস্তিতে থাকতে পারে?

২০১৬ সালে ঢাকা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে মোট ১১ হাজার ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল নগরবাসী দূষণ কমাতে একটি নিদ্দিষ্ট স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলবে। এখন সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। একইভাবে গুলশান এলাকায় ১০০টি স্মার্ট ডাস্টবিন এখন রীতিগত ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সলিড ওয়েস্টেজ বা কঠিন বর্জ্য মাটি ও পানি দূষণেরও অন্যতম কারণ। দূষণকারী বর্জ্যের মধ্যে হাসপাতালের এবং বৈদ্যুতিক বর্জ্য আরো অনেক বেশি মারাত্মক। সরকারি হাসপাতালের চারিদিকে এর প্রতিফলন লক্ষণীয়।

এমন একটি নাজুক অবস্থার শহরে যখন বিভিন্ন উৎসব উদযাপিত হয় তখন মরার উপর খারার যা নেমে আসে।

তাই উৎসবগুলো শুরুর পুর্বেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়।

উদাহরণ স্বরূপ আমাদের-পবিত্র ঈদুল আজহার কথায় আসুন। এই পবিত্র উৎসবে ঢাকা শহরে দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে কমপক্ষে প্রায় ৩০ হাজার টন অতিরিক্ত বর্জ্য উৎপাদন হবে। এই অতিরিক্ত বর্জ্য অপসারণে অবশ্যই অতিরিক্ত প্রস্তুতি আবশ্যক। তা না হলে মশার যে প্রজননক্ষেত্র তার কি পরিমাণ বেড়ে যাবে তা অনুমান করতেই পারছেন। আবার এখন চলছে বর্ষাকাল। এই বর্ষাকালেই মারাত্মক ভেকটরবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গুর-ভয়ালরূপ দেখা যায়। তাই ঈদুল আজহা যেন কোনোভাবেই বিষাদ বয়ে আনতে না পারে সে দিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

প্রতিদিন বর্জ্য অপসারণের কাজে যেসকল যানবাহন যানবাহন ব্যবহৃত হয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীর দিকে লক্ষ্য রাখা অতি জরুরি। ময়লা ভর্তি খোলা যানবাহন যে রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে তা পুরো রাস্তায় ময়লা নিসৃত পানি দ্বারা মারাত্মকভাবে দূষিত করে জনজীবন ও পথচারীদের অতিষ্ঠ করে তোলে। মারাত্মকভাবে দূষিত করে বায়ুমণ্ডলকে। একইভাবে যে ল্যান্ডফিলগুলোতে এই আর্বজনা ফেলা হয় তাও খোলা থাকে। যার ফলে আমিন বাজার ও মাতুয়াল ল্যান্ডফিলের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে জনজীবন ও পথচারীর জীবন অত্যন্ত নির্মম বাস্তবতায় নিপতিত।

আবার অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠা নগরে অনেক বাড়ির অপ্রবেশ্য গলির মধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কিছুতেই প্রবেশ করতে পারে না। তাই ওই স্থানগুলো যেমন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তেমনি পরিণত হয়েছে মশা উৎপাদনের কারখানায়।

আমরা জানি বর্জ্য পদার্থ ব্যাকটেরিয়াসহ অসংখ্য অগনিত অনুজীব বসবাস করে। যা অনেক রোগজীবাণুর উৎস হিসাবে কাজ করে। তাহলে ভাবুন প্রতিদিন স্তূপিকৃত ৫৫ শতাংশ বর্জ্য পদার্থ নিত্যদিন কি পরিমান রোগ ছড়াচ্ছে।

এখন প্রশ্ন এই অসম্ভব নাজুক অবস্থানের উত্তরণ কোথায়। কিভাবে এই মারাত্মক অবস্থা হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

এবার বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরিতে কিছু রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।

বর্জ্য পদার্থ হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে সকল দেশ শীর্ষস্থানী তার মধ্যে চীন ১,১৮,৬৪৫ মেগাওয়াট, যুক্তরাষ্ট্র ৭১,৭১৪ মেগাওয়াট, জামার্নী ৫৭,২০০ মেগাওয়াট, যুক্তরাজ্য ৪১,৭৯৪ মেগাওয়াট এবং ভারত ৪৫,৭৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিবছর উৎপাদন করে থাকে। তাই আমাদের দেশে এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষ করে মেগাশহরগুলোতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তা অবশ্যই আশার আলো দেখাবে।

ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬,৫০০ টন বর্জ্য ও ১২টি মেগা শহর বা সিটি করপোরেশনে প্রায় ১৭,০০০ টন বর্জ্যকে ইনসিনেরেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রায় ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিদিন উৎপাদন সম্ভব। একইভাবে ম্যানহোলের ময়লাও পরিনণ হতে পারে খাটি স্বর্ণে।

ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব ৩০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ নালা (ড্রেনেজ) এবং ৮৮০ কিলোমিটার পয়োনালার উপর ম্যানহোল রয়েছে ৪১ হাজার। দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পাইপ নালার ওপর রয়েছে ৩৩ হাজার ৩৩৩টি ম্যানহোল। এ ছাড়া বিভিন্ন কলোনিতে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব কিছু ম্যানহোল রয়েছে।

ম্যানহোলের বর্জ্যও হতে পারে বায়ো-ফার্টিলাইজারের মূল উৎস। যা বাইরের দেশে রফতানি করে বাংলাদেশ পেতে পারে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা।

এখনই সময় যথার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা শহরকে একটি নান্দনিক শহরে রূপান্তরিত করে মূল অর্থনীতিতে স্থায়ী ভূমিকা রাখার । মশা মাছি বা অন্যান্য বাহকবাহিত রোগ-জীবানুর হাত হতে রক্ষা পেতে স্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া সম্ভব নয়। মানব সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ রোগ জীবাণুর আধার না হয়ে হতে পারে অর্থনৈতিক সাশ্রয় ও সমৃদ্ধির একটি গতিশীল স্থায়ী ব্যবস্থা। এমনভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ক্রমাগত খুইয়ে যাওয়া পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা উপহার দিতে পারবো একটি নান্দনিক স্বাস্থ্যসম্মত প্রাণোজ্বল বাংলাদেশ।

লেখক

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম, মহাখালী ঢাকা ।