ইসরাইলি গণহত্যার তদন্ত

করিম খান কি প্রতিশোধের শিকার

জাতিসঙ্ঘের তদন্ত প্রতিবেদন এবং ICC-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান আগামী দিনে নির্ধারণ করতে এই মামলা একটি ব্যক্তির বিচার নাকি আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সেটা স্পষ্ট হতে হবে।

গাজায় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের তদন্তে ইসরাইলের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কয়েক মাস পর আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ঘটনাটি নিছক কাকতালীয়, নাকি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতিশোধ এই প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে। একজন প্রভাবশালী কৌঁসুলি যখন ন্যায়ের তীর একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের দিকে তাক করেন, তখন তার বিরুদ্ধে হঠাৎ এমন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে তা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।

অভিযোগের কাহিনী ও করিম খানের বর্তমান অবস্থা

একজন প্রাক্তন সহকারী আইনজীবী, মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভূত এক নারী, অভিযোগ করেছেন যে, করিম খান তার ওপর বারবার যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন। এই ঘটনাগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সফর (নিউ ইয়র্ক, কঙ্গো, ইউরোপ) এবং হেগে তার বাসভবনে ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে। করিম খান অবশ্য এসব অভিযোগ ‘পুরোপুরি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, এটি একটি ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা, যার লক্ষ্য তাকে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে দুর্বল করা।

করিম খান বর্তমানে প্রশাসনিক ছুটিতে রয়েছেন এবং তার দায়িত্ব সাময়িকভাবে দুই উপ-প্রধান কৌঁসুলি পালন করছেন। আদালতের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনুরোধে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু হয়েছে, যা পরিচালনা করছে UN-এর Office of Internal Oversight Services (OIOS)। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে তার পদচ্যুতি বা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া : প্রতিহিংসা নাকি নিরাপত্তা?

২০২৪ সালে করিম খান গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের অংশ হিসেবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর ২০২৫ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এসে তার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে তার মার্কিন ভিসা বাতিল হয়, আর্থিক লেনদেন স্থগিত হয় এবং ICC-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, ICC-এর এই পদক্ষেপ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একতরফা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং বিচার বিশ্লেষক এই নিষেধাজ্ঞাকে বিচারবিরোধী ও ন্যায়বিচারের পথে এক বিপজ্জনক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। এবার চিন্তা করুন আমেরিকা আসলে কত বড় বিশ্বমাস্তান এবং ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর বাহক!

রাজনীতি ও ন্যায়বিচারের সঙ্ঘাত

এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার একটি গভীর সঙ্কট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন কোনো কৌঁসুলি বড় কোনো শক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও পেশাগত হামলার ঝুঁকি যে কতটা প্রবল, করিম খানের ঘটনাই তার উদাহরণ। অভিযোগ সত্যি হলে অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু যদি এটি প্রমাণিত হয় যে, এটি একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত, তবে তা হবে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। অপরাধী যখন অভিযোগকারী হয়ে ওঠে, তখন ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকে না, যেমনটি আমরা বাংলাদেশে ভারতীয় তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে দেখেছি।

উপসংহার

করিম খানের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার কেবল আইনি কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এটি একটি রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রও। যেখানে সত্য, বিচার এবং প্রতিশোধ একে অপরকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। জাতিসঙ্ঘের তদন্ত প্রতিবেদন এবং ICC-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান আগামী দিনে নির্ধারণ করতে এই মামলা একটি ব্যক্তির বিচার নাকি আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সেটা স্পষ্ট হতে হবে।

লেখক : কানাডা প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী