একদিকে কাতারের দোহায় ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আরব-ইসলামিক বিশ্বের জরুরি শীর্ষ সম্মেলন, অন্যদিকে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। এই দুই বিপরীত চিত্রই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও একবার গভীর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের প্রতি ওয়াশিংটনের নিঃশর্ত সমর্থন অব্যাহত থাকায় এই অঞ্চলের শান্তি একটি সুদূর পরাহত লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
কাতারের প্রতি আরব-ইসলামিক বিশ্বের সংহতি
গত ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় চালানো ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় সোমবার কাতারে আয়োজিত এক জরুরি আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে উপসাগরীয় এই দেশটির প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করা হয়। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে, হামাস নেতাদের ওপর চালানো এই হামলাকে একটি 'প্রকাশ্য আগ্রাসন', 'আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন' এবং 'আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তির জন্য গুরুতর হুমকি' হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
উদ্বোধনী ভাষণে কাতারের আমির এই আক্রমণকে 'সার্বভৌমত্বের নির্লজ্জ লঙ্ঘন' এবং চলমান যুদ্ধবিরতির 'মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা বানচালের ষড়যন্ত্র' হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি জানান, হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া হামাস আলোচকরা সে সময় একটি মার্কিন প্রস্তাবই পর্যালোচনা করছিলেন।
শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত আরব ও ইসলামিক রাষ্ট্রপ্রধানরা কাতারের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং এই আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির যেকোনো পদক্ষেপে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। নেতারা ইসরাইলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে জরুরি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানান। এর মধ্যে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ এবং ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনার মতো কঠোর পদক্ষেপ। একইসাথে, জাতিসংঘে ইসরাইলের সদস্যপদ স্থগিত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাকে (ওআইসি) আহ্বান জানানো হয়।
ইসরাইলের পাশে ওয়াশিংটন
ঠিক যখন দোহায় এই সম্মেলন চলছিল, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তার আঞ্চলিক সফরের অংশ হিসেবে ইসরাইলে অবস্থান করছিলেন। জেরুজালেমে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইসরাইলের কট্টরপন্থী অবস্থানের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
রুবিও বলেন, "এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন একটি সশস্ত্র শক্তি হিসেবে হামাসের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা প্রয়োজন।" তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা হামাসকে কেবল আরও সাহসী করে তুলবে, যা চলমান শান্তি প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রুবিওর এই সফর একদিকে যেমন ইসরাইলের পরবর্তী সামরিক পদক্ষেপগুলোকে বৈধতা দিচ্ছে, তেমনই আরব দেশগুলোকে একটি সতর্কবার্তাও দিচ্ছে। ইসরাইলি ইনস্টিটিউট ফর রিজিওনাল ফরেন পলিসিস-এর প্রেসিডেন্ট নিমরোদ গোরেন বলেন, "এই সফরের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং, এটি গাজায় ইসরাইলের অতিরিক্ত সামরিক অভিযানের জন্য একটি সবুজ সংকেত হিসেবে কাজ করতে পারে।"
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
দোহায় হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কায়রোভিত্তিক 'আল-ফারাবি সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ'-এর মহাসচিব মোখতার ঘোবাশি যুক্তরাষ্ট্রকে এই হামলায় 'সহ-অপরাধী' হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, "কাতারে বিশাল মার্কিন বিমানঘাঁটি এবং শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। ইরানের হামলার সময় এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকলেও ইসরাইলি হামলার সময় তা সম্পূর্ণ নীরব ছিল।"
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা আরব মিত্রদের প্রতি ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি এবং যুদ্ধ বন্ধে ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়াশিংটন এই একপেশে নিঃশর্ত সমর্থন অব্যাহত রাখবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন তারা।