চলতি মাসের ৩ তারিখে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের একটি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে হেফাজত নেতাদের পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী, এনসিপি নেতা হাসানাত আবদুল্লাহ এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানসহ অনেকে। এই সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। সমাবেশে হেফাজত নেতারা ১২ দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল। আলেম ওলামাদের পরামর্শক্রমে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারী সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন। নারীর সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ প্রত্যাহার ও নিজস্ব সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য প্রদান।
তাদের ২ নম্বর দাবি ছিল সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন। ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ঈমান ও আমল রক্ষার্থে বহুত্ববাদের প্রত্যাহার। এ ছাড়া লিঙ্গ পরিচয়, লিঙ্গ বৈচিত্র্য, লিঙ্গ সমতা, তৃতীয় লিঙ্গ প্রভৃতি নিয়ে ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও সমাজবিধ্বংসী সমকামীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করা। শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করা। জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার নিশ্চিত করা। গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিচার নিশ্চিত করা। বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করা। আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর নামে কটূক্তিকারী ও বিষোদগার বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন।
চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে সাইফুল ইসলাম হত্যার উসকানিদাতা চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহারপূর্বক তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে প্রতিবাদী আলেম ওলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী ও ইসলামপ্রিয় তরুণদের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট সব মামলা অতিসত্বর প্রত্যাহার করা। জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ইসলামপন্থী ও আলেম ওলামাদের গত ১৫ বছর ধরে যারা নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা। গাজার মুসলমানদের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের চলমান গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদে আমাদের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং ইসরাইলি পণ্য বয়কট করা।
৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। শিক্ষার প্রাথমিক থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশী মিশনারি অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারকে উদ্যোগী হওয়া। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা সঙ্কট কমাতে সেখানে আলেম সমাজের দাওয়াতি কার্যক্রমের নিরাপদ সুযোগ দেয়া ও সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো বৃদ্ধি করা।
কাদিয়ানিদের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং সাধারণ মুসলমানদের ঈমান আকিদা রক্ষার্থে কাদিয়ানিদের অপতৎপরতা বন্ধ করা। এসব দাবি দ্রুত আদায়ের জন্য হেফাজত নেতারা সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছেন। সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হাসিনাকে তাড়াতে ৩৬ দিন লেগেছে। আপনাদের তাড়াতে ছয় দিনও লাগবে না। এ লক্ষ্যে তারা বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠান। ২৩ মে বাদ জুমা দেশজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি। সমাবেশে উত্থাপিত দাবির প্রতি দেশের কতিপয় নাস্তিক ছাড়া সবারই সমর্থন আছে বলে আমি মনে করি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও এ দাবিগুলোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে হেফাজত নেতাদের কাছে কতিপয় নিবেদন পেশ করছি।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মোট ৪৪টি। তার মধ্যে ১৩টি হলো ইসলামী দল। হেফাজতে ইসলামের দাবি মতে তারা একটি ‘অরাজনৈতিক’ সামাজিক ইসলামী সংগঠন। অথচ দু-একজন বাদে সংগঠনটির সব নেতাই কোনো না কোনো ইসালামী দলের সাথে যুক্ত।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত ১৩টির বাইরেও কমপক্ষে ৩০টি ইসলামী রাজনৈতিক দল আছে। তার মানে দেশে ইসলামী দলের সংখ্যা প্রায় ৪৫।
হেফাজতের নেতারা যেসব ইসলামী দল করেন সেগুলো আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই ঘরানায় বিভক্ত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা দুই দল বা জোট থেকেই মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মাওলানা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের একটি গ্রুপ আওয়ামীঘেঁষা হয়ে পড়েন। সেই গ্রুপটি এখন আবার বিএনপিঘেঁষা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়েছেন। হেফাজতের সাথে যারা যুক্ত তাদের অধিকাংশই প্রধানত পাঁচটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। সেই পাঁচটি ইসলামী দল হলো খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট।
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়া আর সব ইসলামী রাজনৈতিক দলেই হেফাজতের লোকেরা আছেন। এ প্রসঙ্গে হেফাজতের এক নেতা একসময় বলেছিলেন, ‘যদি কেউ হেফাজতের নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী হয়, ঈমান ও আকিদার যে দাবিদাওয়া তার সাথে যদি একমত হয় এবং নাস্তিকদের যদি সমর্থন না করে, তাহলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা যেকোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও হেফাজতের সদস্য হতে বাধা নেই। শর্ত শুধু একটিই, হেফাজতে কোনো দলীয় রাজনীতি করা যাবে না।
হেফাজতে ইসলামী সাধারণত কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক একটি আলেম সংগঠন। তারা দেওবন্দি আকিদায় বিশ্বাসী। অন্য আকিদার আলিমদেরকে তারা প্রকৃত আলেম হিসেবে গণ্য করেন না। দেশে দেওবন্দি আকিদায় বিশ্বাসী আলেমরা ১৩টি উপদলে বিভক্ত।
এ ১৩টি উপদল হলো ১. তাবলিগ জামাত (দেওবন্দপন্থী), ২. তাবলিগ জামাত (সা’দ কান্দলভিপন্থি), ৩. ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই), ৪. জমিয়তে ইসলাম (ওয়াক্কাস), ৫. জমিয়তে ইসলাম (নূর হোসাইন কাসেমী), ৬. খেলাফত আন্দোলন, ৭. খেলাফত মজলিস, ৮. ইসলামী ঐক্যজোট (আজিজুল হক), ৯. ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী), ১০. ইসলামী ঐক্যজোট (মেসবাহুর রহমান), ১১. ইসলামী ঐক্যজোট (ইজহারুল ইসলাম), ১২. নেজামে ইসলাম ও ১৩. হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলাম আবার দুই ধারায় বিভক্ত। যাই হোক, সমাবেশ থেকে হেফাজত নেতারা শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার ৯৩ জন শহীদের নাম প্রকাশ করেছেন। গণহত্যার এক যুগ পরে শহীদদের নাম প্রকাশ করা হলো! সমাবেশে কয়েকজন নেতার শব্দচয়ন ছিল খুবই আপত্তিকর। অবশ্য এ জন্য তারা পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়েছেন। মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় তাদের ভয়ে আপনারা শহীদদের নাম প্রকাশ করতে সাহস পাননি।
ড. ইউনূস শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি ও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের সব আলেম একযোগে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েও এ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে পারেননি। আপনাদেরকে ইসলাম প্রচারের অবারিত সুযোগ করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। আপনারা সে সুযোগ কি যথাযথ কাজে লাগাতে পারছেন? এখনো আপনাদের নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বিদ্যমান। আপনারা জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দলের নেতাদেরকে দাওয়াত দেননি। এটি একধরনের বঞ্চনার নীতি, যা শোভন হয়নি।
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দলের নেতাদেরকে দাওয়াত দিলে জাতীয় স্বার্থ আরো উচ্চকিত হতো। আপনাদের মনে থাকা দরকার, আপনাদের হুঙ্কার, তর্জন-গর্জন দেশে খুব বেশি গুরুত্ব পায় না আপনাদের অনৈক্য আর হিংসা-বিদ্বেষের কারণে। আপনাদের অনৈক্য ও অদূরদর্শী, কিছু ক্ষেত্রে ফতোয়াবাজি জাতির কাছে আপনাদেরকে ফেলনা বানিয়ে দেয়। আরেকটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শিক্ষাব্যবস্থায় আপনাদের সংস্কার আনতে হবে; যাতে কারো কাছে হাত পাততে না হয়। সমাজে বসবাসরত অধিকাংশ এলিটদের কাছে আপনারা আলেম সমাজ গুরুত্বহীন ও অপাঙ্ক্তেয় কেন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আপনাদের আকাবির মুফতি আমিনী ও আল্লামা আজিজুল হক বিএনপি ও জামায়াতের সাথে নির্বাচনী ঐক্য করেছিলেন।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক একবার আওয়ামী লীগের সাথেও ঐক্য করেছিলেন। সেখানে দেওবন্দি আকিদার কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু আপনারা তাদের উত্তরসূরি হয়ে বিএনপির সাথে সমঝোতা করতে পারলেও জামায়াতের সাথে নির্বাচনী ঐক্য করতে পারছেন না! বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক। আপনাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। জাতির জন্য ভালো কিছু চাইলে খামখেয়ালি করা যাবে না।
ইসলামমনা ও ভারতবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। বিশেষত এ ক্ষেত্রে আলেম সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে মুখ্য হওয়া উচিত। আপনাদের মনে থাকা দরকার, উপমহাদেশ থেকে ইসলামকে মুক্ত করার জন্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ব্যাপক মিশনারি কাজ করে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশকে গাজায় পরিণত করার হুমকি দিয়েছে। ওদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আপনাদের ভূমিকা হওয়া দরকার অত্যন্ত দূরদর্শী ও সময়োপযোগী।
ইসলামী আন্দোলন চরমোনাইয়ের একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে একজন নারী সাংবাদিককে বের করে দেয়ার দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এটি নিয়ে দেশের সংবাদ অঙ্গনে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। তিনি ছিলেন ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত সাংবাদিক। আমন্ত্রিত একজন সাংবাদিককে বের করে দেয়া শিষ্টাচারের আওতায় পড়ে না। যখন দুনিয়াব্যাপী আলেমদেরকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে ঠিক তখন এমন একটি ঘটনা কোনোভাবেই সঠিক হয়নি।
ইতোমধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের মানচিত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশবাসী ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় আলেম সমাজ পুরো দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এটিই আমাদের কামনা। সুতরাং নিজেদের ভেতরে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করুন, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করুন এবং বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দিন!
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া