বাংলাদেশে ভবিষ্যতের সঠিক, জবাবদিহিমূলক ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের উত্থানের একমাত্র পথ হলো রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থা প্রবর্তন অর্থাৎ প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে যে ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিদেশী প্রভাবাধীন শাসনব্যবস্থা টিকে ছিল, তার মূল ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় ব্যবস্থা- যা এক কথায় বিদেশী চক্রান্তের ফসল। নব্বই পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই গভীর ষড়যন্ত্র বুঝে উঠতে পারেনি।
শুধু ভারত বা যুক্তরাজ্যে এই ব্যবস্থা আছে বলেই বাংলাদেশেও তা কার্যকর হবে এমন ভাবনা বাস্তবতাবর্জিত। কারণ, প্রতিটি দেশের সামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বাস্তবতা ভিন্ন। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু থাকলে শেখ হাসিনার মতো ভারতনির্ভর ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব কোনো দিন টুিঙ্গপাড়ার একটি আসনে জয়ী হয়ে দলীয় প্রধান হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করতে পারতেন না।
আসলে সংসদীয় ব্যবস্থার ফাঁদে পড়েই দেশের রাজনীতি থেকে জাতীয় নেতৃত্ব বিলুপ্ত হয়েছে; ক্ষমতা চলে গেছে একটি স্বৈরতান্ত্রিক গোষ্ঠীর হাতে। তাই এখনই সময় স্পষ্টভাবে বলার রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থাই হওয়া উচিত জাতীয় সংস্কারের প্রথম ও প্রধান ধাপ। এরপর এই ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন সংসদ ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে। ড. ইউনূস ও তার সংস্কার টিম এই মৌলিক বিষয়টি এখনো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন না এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক। কেন তারা এটা বুঝতে চাইছেন না, তা বোধগম্য নয়।
সে যাক, এ ব্যবস্থা কেন দরকার সে যুক্তি আমরা এ নিবন্ধে তুলে ধরব।
রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার পক্ষে যুক্তিসমূহ :
১. জনগণের সরাসরি নির্বাচিত নেতৃত্ব : রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব সরাসরি দেশের সব নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত হন। এতে একজন নেতাকে সারা দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হয়। শুধু দলীয় সমর্থন বা একটি আসনে জয় পেলেই যেমন প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট নয়। এই ব্যবস্থায় জনগণের সত্যিকারের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
২. একক নেতৃত্বে জবাবদিহি সহজ হয় : বর্তমানে একটি ভুল সিদ্ধান্তের দায় কেউ নেয় না, সবাই একে অন্যকে দোষ দেয়। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থায় একজন প্রেসিডেন্ট পুরো প্রশাসনের দায়িত্বে থাকেন, ফলে ব্যর্থতার জন্য তাকে সরাসরি দায়ী করা যায়। এতে দায়িত্ববোধ ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।
৩. অস্থিতিশীল সরকার গঠনের সুযোগ থাকে না : সংসদীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে জোট সরকার হয়, যা প্রায়শই দুর্বল ও অস্থির হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থায় প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত থাকেন, সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সংসদে সংখ্যার ওপর নির্ভর করতে হয় না। এতে শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল থাকে।
৪. দলীয় সংসদ সদস্যদের শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ কমে : বর্তমানে মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতারা প্রশাসনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিত্ব আলাদা থাকে, ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেকাংশে হ্রাস পায়।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি বিন্যাস সম্ভব হয় : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থায় প্রেসিডেন্ট, সংসদ এবং বিচার বিভাগ এই তিনটি স্তরে ক্ষমতার বিভাজন থাকে। এতে কোনো একটি পক্ষ একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদ ও সরকার একীভূত হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
৬. নবীন নেতৃত্বের উত্থান সম্ভব হয় : রাষ্ট্রপতি শাসনে দলীয় সিনিয়রিটি বা পারিবারিক উত্তরাধিকার নয় যোগ্যতা, মেধা ও সাহসের ভিত্তিতে নেতৃত্ব উঠে আসে। এতে তরুণ, উদ্ভাবনী ও দেশপ্রেমিক নেতাদের জন্য পথ খুলে যায়।
৭. সীমিত মেয়াদে ক্ষমতা চর্চার নিশ্চয়তা : সম্প্রতি ড. মাহমুদুর রহমান (সম্পাদক, আমার দেশ) রাষ্ট্রপতি শাসনব্যস্থার সাথে দুই মেয়াদে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও শক্তিশালী সংসদের প্রস্তাব করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যালান্সড গভার্নেন্স মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার প্রস্তাবের সাথে একমত এবং এই প্রস্তাবটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য ড. ইউনূসকে আহ্বান জানাই। নতুন নেতৃত্বে বিশ্বাসী সব দল ও নাগরিকদের উচিত এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।
৮. দেশপ্রেমিক ও জাতীয় চিন্তায় সমন্বিত নেতৃত্বের উত্থান সম্ভব : রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু হলে, ৫১% ভোট না পেয়েও কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা জোট গঠন করে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এতে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথ বন্ধ হবে। রাষ্ট্রপতিকে হতে হবে গোটা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য, স্বাধীনচেতা, সাহসী ও জবাবদিহিমূলক এক নেতা, যার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই হবে সারা দেশের সব স্তরের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিকাশে এটাই হবে সর্বাধিক উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা।
লেখক : কানাডা প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক



