ঢাকা মহানগরী শুধু একটি শহর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ জীবিকা, শিক্ষা ও সেবার খোঁজে এই শহরে ছুটে আসেন। অথচ এই মহানগরীর বুকেই কিছু অঞ্চল যেন হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। তেমনই একটি এলাকা হলো তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ৭ নম্বর রোড। একসময় যা ছিল দেশের অন্যতম সুশৃঙ্খল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, আজ তা পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও প্রশাসনিক উদাসীনতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
এই সড়কের আশপাশে রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, হামিম গ্রুপ, চ্যানেল ২৪, দৈনিক সমকালসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও সংস্থা। এগুলোর অনেকগুলোই Key Point Installation (KPI) তালিকাভুক্ত, যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের মৌলিক দায়িত্বের অন্তর্গত। অথচ বাস্তবতা হলো, এই এলাকাটি কার্যত দখল করে নিয়েছে কিছু ট্রাক মালিক ও শ্রমিক গোষ্ঠী, যারা দিনের পর দিন গড়ে তুলেছে অবৈধ গাড়ি মেরামতের কারখানা, গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ এবং ট্রাক স্ট্যান্ড।
শৃঙ্খলার মুখে প্রহসন
প্রায় ৮০ ফুট প্রশস্ত সড়ক এবং দুই পাশের ফুটপাত আজ ব্যবহৃত হচ্ছে যত্রতত্র ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। গাড়ির যান্ত্রিক মেরামত, স্প্রে রঙ, ধাতব কাটাকাটি, ওয়েল্ডিং—এসব চলতে থাকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। ফলে একদিকে সৃষ্ট হচ্ছে দৃষ্টিকটূ শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ, অন্যদিকে পথচারীদের চলাচল হচ্ছে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, অফিসগামী মানুষ—সবাই যেন এই বিশৃঙ্খলার জিম্মি।
বিশেষ করে রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, একটি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক নারী ও দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী রয়েছে—তারা প্রতিনিয়ত পড়ছে নিরাপত্তাহীনতায়। পথঘাটে মাদকাসক্ত ভবঘুরে, হকার, গ্যারেজ শ্রমিকদের অশালীন আচরণ এবং দূষিত পরিবেশে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।

অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমনকি কিছু শিক্ষার্থী ইতোমধ্যেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দিনে দিনে কমছে। শিক্ষকেরা নিরাপত্তা ও পরিবেশগত কারণে নিরবিচারে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতি একটি শিক্ষার মণ্ডপকে রীতিমতো অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রশাসনিক নিস্পৃহতা: দেখেও না দেখা
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত বড় নৈরাজ্য এবং অসহনীয় পরিস্থিতি চলতে থাকলেও সরকারি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কার্যত শূন্য। রয়েল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ভিসি অধ্যাপক ড. এএনএম মেশকাত উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সমস্যার বিস্তারিত তুলে ধরেন। পুলিশ কমিশনার আশ্বাস দেন ব্যবস্থা গ্রহণের, কিন্তু এরপরও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।
একাধিকবার পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগকে জানানো হলেও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। বরং দিন দিন অবৈধ দখলদারিত্ব আরও বেড়েছে। এখন শুধু রাস্তার এক পাশে নয়, উভয় দিকেই ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখছে। গ্যারেজগুলোর সংখ্যা বেড়ে গেছে, রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে চলাচল বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। এটি শুধু ট্রাফিক সমস্যা নয়—এটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা অবনতির একটি ভয়ঙ্কর বার্তা।
কারা এই দখলদারদের পৃষ্ঠপোষক?
সাধারণভাবে প্রশ্ন ওঠে—এত বড় অবৈধ কার্যক্রম কীভাবে দিনের আলোয় নির্ভয়ে চলতে পারে? এর পেছনে নিশ্চয়ই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মদদ আছে। এদের কেউ কেউ শ্রমিক সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায়, কেউ বা রাজনৈতিক ছাতার নিচে থেকে প্রশাসনের চোখকে ধুলো দিচ্ছে। প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির নীরব সমর্থন ছাড়া এই নৈরাজ্য এতটা বিস্তার লাভ করতে পারত না।
রাষ্ট্রের দায় ও জনসচেতনতার ঘাটতি
আমরা ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর নগরায়ণ ও আইনের শাসন ছাড়া উন্নয়নের যে কথা বলা হয়, তা একটি ফাঁপা বুলি মাত্র। একদিকে যখন সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ, আধুনিক নগর পরিকল্পনার কথা বলছে, তখন তেজগাঁওয়ে এই চিত্র একটি নির্মম পরিহাস।
এই অবস্থার জন্য শুধু প্রশাসন নয়, জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। শহরের প্রতিটি সমস্যা সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না। আমাদেরকেই রাস্তায় নামতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
জরুরি কিছু সুপারিশ
- এই সংকট নিরসনে এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন:
- অবৈধ গাড়ি মেরামতের কারখানাগুলো উচ্ছেদে অভিযান চালাতে হবে।
- ট্রাকস্ট্যান্ড স্থানান্তরের জন্য পরিকল্পিত জায়গা নির্ধারণ করতে হবে।
- নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় স্থায়ী পুলিশ টহল ও সিসিটিভি কার্যক্রম চালু করতে হবে।
- পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে শব্দ ও বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ অভিযানে নামতে হবে।
- কেপিআই এলাকায় নিয়মিত গোয়েন্দা তৎপরতা এবং নজরদারি চালাতে হবে।
- স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এসব বিষয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে।
শেষ কথা
তেজগাঁওয়ের এই চিত্র কেবল একটি এলাকার সমস্যা নয়—এটি রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন উদাহরণ। আজ যদি আমরা এর প্রতিবাদ না করি, কাল এই নৈরাজ্য আমাদের ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস চত্বরে গিয়ে দাঁড়াবে। আজ যদি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ না থাকে, আগামীকাল রাষ্ট্রও নিরাপদ থাকবে না।
আমরা যারা শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক, সাংবাদিক—আমরা যদি আমাদের আওয়াজ না তুলি, তবে এই শহর একদিন মানুষের নয়, গাড়ি, গ্যারেজ ও গডফাদারদের দখলে চলে যাবে।
এখনই সময় প্রশাসনকে জাগানোর। এখনই সময় জনতার চেতনায় আগুন ধরানোর। নইলে আগামীকাল হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
লেখক
শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক