আলোকিত অন্ধকার

ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন শিক্ষকরা উপদেশ দিতেন— আলোকিত মানুষ হও। আলোকিত মানুষ সত্যিই সমাজের অন্ধকার দূর করে এমন বদ্ধমূল ধারণা মনের মধ্যে লালন করতাম।

প্রতীকী ছবি

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় আলো বলতে আমরা বুঝি এক প্রকার শক্তি, যা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে মহাকাশে (শূন্য মাধ্যমে) এবং বিভিন্ন মাধ্যমে (যেমন বাতাস, পানি, কাচ) পরিবাহিত হয় এবং আমাদের চোখে দেখার অনুভূতি জাগায়। এটি একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ, যা কণা ও তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। আলোর এই বিস্তৃত রূপটি গামা রশ্মি থেকে শুরু করে রেডিও তরঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে দৃশ্যমান আলো এই তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আলো যখন কোনো পদার্থের ওপর পতিত হয় তখন সেই পদার্থের সকল দিক উন্মোচিত হয়।

ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন শিক্ষকরা উপদেশ দিতেন— আলোকিত মানুষ হও। আলোকিত মানুষ সত্যিই সমাজের অন্ধকার দূর করে এমন বদ্ধমূল ধারণা মনের মধ্যে লালন করতাম। যখনই কোনো ভালো মানুষের আলোচনা শুনতাম, জানতাম তার ভালো মানবতাবাদী কর্ম তখনই বুঝতাম তিনি একজন আলোকিত মানুষ। আবার যখন বাবার মুখে শুনতাম মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়। কর্ম মানেই তো মানবতার তরে নিজেকে নিমজ্জিত রাখা। যখন দেখতাম পলান সরকারের মতো মানুষ নিঃস্বার্থভাবে চোখের আলোর সাথে মানবতার আলোর পরিস্ফূরণের জন্য বৃদ্ধ বয়সেও নিজে ঘুরে ঘুরে বই বিতরণ করছেন। তখন মনে হতো আলোকিত মানুষের জন্মটাই সার্থক।

বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ তো এমনই। সকল ধর্মের যারা পথ-প্রদর্শক হিসেবে এসেছিলেন তাদেরই একই কর্ম ছিল— মানুষকে আলোকিত করা। আমরা জানি যে ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণী বাহক প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: যখন এই পৃথিবীতে আগমন করেন তখন এই পৃথিবী ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। অর্থাৎ আলোর উপস্থিতি মানুষের হৃদয়ে ছিল না। যে আলো পড়লে মানুষ ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, মানবতা-নিষ্ঠুরতা, সত্য-মিথ্যার বিভেদ সহজেই করতে পারে। প্রিয় নবীজী সেই আলোর মাধ্যমে অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষগুলোকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করেছিলেন।

হজরত মুহাম্মদ সা:-এর যুগ থেকে আজ আমরা অনেক দূরে অবস্থান করলেও সকল মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে তার আদর্শ চির অমলিন। আজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমরা সেই আলো বিতরণ করার মাধ্যমে অন্ধকার দূর করছি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রেরও একটি স্লোগান আছে, ‘আলোকিত মানুষ চাই’। এত আলোর মাঝে কেন তাহলে অন্ধকার তার জায়গা করে নিবে? কেন সেই অন্ধকারে সত্য-মিথ্যা ঢেকে যাবে? কেন জালিমের নির্যাতনে মজলুম নিষ্পেষিত হবে? কেন অন্ধকারের দাপটে আলোর কর্মমতা বিলুপ্ত হবে?

যে মানুষগুলো আজ ঘুষ খাচ্ছে, দুর্নীতি করছে, অবৈধ ভোগ-বাণিজ্যে ব্যস্ত আছে, অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের লাগামের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষের মৌলিক চাহিদা- চিকিৎসার নামে আউট পকেটে খরচ বাড়িয়ে মানুষের চরম দুর্ভোগের কারণে পরিণত হচ্ছে। এখান থেকেই মনে প্রশ্ন জাগে— এই মানুষগুলো কারা?

পৃথিবীর কোনো মা-বাবাই চায় না তার সন্তান অন্ধকারে নিমজ্জিত হোক। কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ই তৈরি হয় না অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ তৈরির অভিপ্রায়ে। কোনো শিক্ষকই অন্যায়, মিথ্যাচার, অমানবিকতা শেখান না। তাহলে পৃথিবীতে কেন এত অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, জুলুম, অত্যাচার? তাহলে কি বুঝতে হবে এই মানুষগুলো কোনো মায়ের গর্ভেই জন্ম নেননি? কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনাই করেননি? কোনো শিক্ষকের কাছেই যাননি?

প্রশ্নগুলোর উত্তর অত্যন্ত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার আমাদের সবার কাছে। বরঞ্চ যে মানুষগুলো আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন, অত্যন্ত কুৎসিত ও জঘন্যতম কাজগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রায় ক্ষেত্রে অত্যন্ত অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাবা-মায়ের অতি সম্মানিত সন্তান। তাহলে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে সব আলোকিত আয়োজন থেকে জন্ম নিচ্ছে গভীর বিদঘুটে অন্ধকার?

এই অন্ধকারের নাম কী হবে, ভাবুন একবার! এই অন্ধকারকে কি ‘আলোকিত অন্ধকার’ বললে মিথ্যা বলা হবে? না বেশি কিছু বলা হবে? সকল অন্ধকার আজ আমাদের গ্রাস করে চলেছে। সবাই শুধু নিজের মুনাফার জন্য সকল আলোকিত শিক্ষা, সভ্যতা আর ভব্যতা নিজের কুৎসিত (অন্ধকার) চিন্তার চাদরে আবৃত করে রেখেছেন। করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই স্কেলে বিশ্বের ১৪৮টি রাষ্ট্র দুর্নীতির দুষ্টচক্রের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে বহুদিন যাবৎ।

সারা বিশ্বের সবচাইতে বড় সমস্যা পরিবেশ বিপর্যয়। যেখানে সকল নৈতিকতার কবর রচনা করে চলছে পেশীশক্তি, অর্থনৈতিক অহংকার ও ক্ষমতার দাম্ভিকতা। গাজাবাসীর দিকে তাকালেই কি বুঝতে বাকি থাকে আলোকিত অন্ধকারে কিভাবে মানবতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে! বিশ্ববেহায়া, বিশ্ব মানবতা লঙ্ঘনকারী নেতানিয়াহু কিভাবে আলোকিত মানব সভ্যতাকে অন্ধকারের চাদরে ঢেকে দিচ্ছে!

আমাদের ছোট্ট এই দেশটার দিকে নজর দিলেই পরিচ্ছন্নভাবে বোঝা যায় ক্ষমতার কালো থাবা কিভাবে কত সহজেই বিপর্যস্ত করে সভ্যতা আর মানবতাকে। কত সহজেই ঢাকা শহরের সকল ড্রেন ও ডিচেস দখল হয়ে যায়। থমকে যায় ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি নিষ্কাশনের সকল পথ। জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে নগরবাসী। কত সহজেই বিভিন্ন উৎসবে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন হয়ে যায়। দুই ঈদে কত সহজেই যাতায়াত ভাড়া বেড়ে যায়। কত সহজেই দুর্ভোগ বেড়ে যায় নাড়ির টানে গ্রামে ফেরা মানুষগুলোর। রোজা এলেই ইফতারসামগ্রীর দাম কিভাবে হু হু করে বেড়ে যায়। কিভাবে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অপরিপক্ক বিভিন্ন ফলমূলে মেশানো হয় মানবঘাতক বিষাক্ত পদার্থ। কত সহজেই গড়ে উঠছে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট। কত স্বাচ্ছন্দ্যেই নিম্নমানের অস্বাস্থ্যকর খাবারে চোখধাঁধানো বিষাক্ত রং মাখিয়ে অধিক মূল্যে বিক্রি করা হয়। কত সহজেই নগরীতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশেপাশে কোনো খেলার মাঠের ব্যবস্থা না করে বিষাক্ত জাঙ্ক ফুডের দোকান গড়ে উঠছে। এই জাঙ্ক ফুডের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অকর্মন্য ডিজেবল জাতি হিসেবে গড়ে উঠছে।

ভূমি রেজিস্ট্রি ও মিউটেশনে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও অতিরিক্ত অর্থ লেনদেনে নিষ্পেষিত হচ্ছে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের সকল স্থানেই কী এক অদ্ভুত অন্ধকারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা!

এই দুষ্টচক্রের নিয়ন্ত্রণকারীরা কোনো মুর্খ মানুষ নয়। এই কাজগুলোর মূলে রয়েছেন ওই আলোকিত মানুষগুলো, যারা আসলে নিজেকে আলোকিত করেছেন অন্ধকারে পরিস্ফূরণের জন্য। এই আলোকিত অন্ধকার যতদিন দূর না হবে ততদিন মানবতার মুক্তি কি সম্ভব?

তবে আশার কথা হলো আমাদের নতুন প্রজন্ম। আলোর কনর্ভাজেন্ট ধর্ম যেমন আলোক রশ্মিকে একত্রিত করে কোনো কিছুকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারে, তেমনিভাবে আমাদের সবার সহযোগিতায় জেন-জি’রা সকল অন্ধকার দূর করে আলোয় আলোয় ভরে তুলবে পুরো দেশ।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা।