রাজনীতির মারপ্যাঁচ ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারকে পরাজিত করে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো একসাথে কাজ করেছিল, সেই রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার জাঁতাকল থেকে রাষ্ট্রকে পরিত্রাণ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহে প্রথমে সংস্কার কমিশন ও পরে যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছিল; সেই কমিশন রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে- এ কথা বলার এখন আর উপায় নেই।
গত ২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কমিশনের সুপারিশকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করার পরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে চলে আসে। যা নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা ও এখতিয়ারবহিভর্‚ত পদক্ষেপ নেয়ার অভিযোগ এনেছে। বিএনপির অভিযোগ, ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনাকালে যেসব বিষয় ছিল এবং জুলাই সনদ যেটি স্বাক্ষর করা হয়েছে তার সাথে জমা দেয়া সুপারিশের মিল নেই। ভিন্নমতসহ অনেক বিষয় বাদ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে। এসব কারণে দেশের বিএনপির পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, জুলাই সনদে বিএনপির স্বাক্ষরিত কোনো পাতা নেই। অন্য পাতা সেখানে যুক্ত করে জমা দেয়া হয়েছে, এটি খুব দুঃখজনক ও প্রতারণামূলক কাজ। জনগণের সাথে এমন প্রতারণা চলতে পারে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতীতের গণভোটের আদলে হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজনের হিড়িক পড়েছে। বিএনপির এমন অভিযোগে জুলাই সনদ নিয়ে দেশে নতুন করে সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এক বিবৃতিতে শেষ মুহূর্তে এসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরির পথ সৃষ্টি করেছে- এমন অভিযোগ তুলে বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশকে কেন্দ্র করে জাতীয় নির্বাচন আবারো একটি সঙ্কটের মধ্যে পড়ল। অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো মোটাদাগে একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছিল এবং সেই অনুযায়ী জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি আমরা। কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এমন কিছু জায়গায় পরিবর্তন এনেছে যা অনেক রাজনৈতিক দলের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে তার সমালোচনা করে বলেছেন, যেখানে কমিশন গঠন করে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সবগুলো রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বসেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, সেখানে দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছবে, এই প্রত্যাশা করা অবান্তর। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে- সরকার সাত দিন পর নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। তাহলে এতদিন ধরে সেশনের পর সেশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এদিকে জামায়াতে ইসলামী জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিতে বারবার গণভোটের দাবি জানিয়ে আসছে। একই দিনে গণভোট ও সংসদ নির্বাচনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে দলটি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক জুলাই সনদ বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনাকালে বলেছেন, আগে গণভোট পরে সংসদ নির্বাচন, এ ধারণা সম্পূর্ণ আইনের পরিপন্থী। সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি ধারণা থেকে সংসদ নির্বচনের আগে গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। সাধারণত সংসদ একটি আইন পাস করলে বা সংবিধানের সংশোধন পাস করলে, দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে জনগণ সেটিকে গ্রহণ করছে কি- না সেজন্য গণভোট হয়। দুনিয়ার সব দেশের রেওয়াজ হলো একটি প্রস্তাব সংসদে পাস হবে, তারপর জনগণের কাছে গণভোটে যাওয়া হবে। আগে গণভোট পরে সংসদ, এটি আইনের পরিপন্থী। গত ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি আরো বলেন, নির্বাচিত সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করবে। এখানে ব্যর্থ হলে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপন হবে। প্রশ্ন হলো- স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে ২৭০ দিনে আলোচনার যুক্তি কী? ফল আগে বলে দিয়ে থাকলে আলোচনা করে লাভ কী। এটি সম্পূর্ণ যুক্তিহীন একটি অবাস্তব প্রস্তাব।
দেশের বিশিষ্টজনদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ‘গণভোট’ ইস্যুতে অনড় অবস্থানে রয়েছে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশ জারি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গণভোটের দিন-ক্ষণ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য অন্তর্বর্তী সরকারকেও বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এ-ই সব ইস্যুতে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এতে দেশের আমজনতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে দলগুলো এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। যা সরকারকে রীতিমতো সঙ্কটে ফলে দিয়েছে। ফলে এই রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীরতা উপলব্ধি করে বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক পর্যন্ত গড়িয়েছে।
৩ নভেম্বর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ, সংবিধান সংস্কার আদেশ চূড়ান্তকরণ এবং এতে উল্লিখিত গণভোট আয়োজন ও গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ উদ্যোগে আলোচনায় বসে মতৈক্যে পৌঁছানো এবং ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দিতে উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়, সেই সময়সীমাও চলে গেছে।
রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথমে ১১ সংস্কার কমিশন এবং পরবর্তীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিগত প্রায় এক বছরের পরিশ্রম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক, ঘটা করে গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর করা হয়। বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদ-অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে জমা দেয়ার পর উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে সব কিছু নিষ্ফল হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
দাবি উঠেছে, জুলাই সনদে প্রধান উপদেষ্টার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরে আদেশ জারি করার। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ৮৪টি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ৬১ প্রস্তাবে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
বাস্তবতা হচ্ছে- দেশবাসী দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্র মেরামতের দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি বন্ধ করে মানবাধিকার ও সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তৃণমূল পর্যায় থেকে এ দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, যা বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনা সরকারের পলায়নের পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে সংস্কারের দাবি জোরালো করে তুলে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত পদক্ষেপ বিশেষ করে সংস্কার কমিশনগুলোর নাতিদীর্ঘ সংস্কার প্রস্তাব, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতা এবং দীর্ঘ সময় ব্যয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তার লক্ষণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দেশের মানুষ ক্রমশ সংস্কারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিষয়টি সরকার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে। আর সংস্কার করলে রাতারাতি সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে- এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই। ছাত্র-জনতার রক্তের স্রোতধারায় এত বড় একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল, তারপরও এখন পর্যন্ত ঘুষ, দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তির প্রভাব কোনো কিছু কমেনি, সবকিছু সেই আগের মতো আছে। অথচ ব্রিটেনে লিখিত কোনো সংবিধান নেই। তবু তারা বিশ্বে অন্যতম সভ্য জাতি। কাজেই জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিক উন্নতি না হলে এ সংস্কারকার্যক্রমও কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনবে বলে মনে হচ্ছে না।
সরকার, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি মধ্যকার ত্রিমুখী অবস্থান দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছি আমরা আমজনতা। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে অনৈক্যের পথ ধরে ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের পথ তৈরি হতে পারে। কাজেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে রাজনৈতিক দল ও সরকারকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর আছে বলে আমাদের মনে হয় না।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট



