১৯৭১ সালে দেশের মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল। ২৬ মার্চ দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। স্বাধীন দেশের নাম রাখা হয়েছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এর মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের নিজেদের শাসন করার অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল। আরো স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল জনগণের দেশ। সে দেশের পরিচালকদের হওয়ার কথা ছিল গণতান্ত্রিকভাবে স্বতঃর্স্ফূতভাবে নির্বাচিত। আর দেশের সমাজ হওয়ার কথা ছিল সব ধরনের শোষণ, বৈষম্যমুক্ত আর ন্যায়ভিত্তিক। এটিই আমাদের বহুল ব্যবহৃত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। এ বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে উল্লেøখ আছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের প্রথম ভাগে প্রজাতন্ত্রের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।”
অর্থাৎ দেশের জনগণই হবে সব ক্ষমতার মালিক। জনগণ তাদের মতো করেই তাদের দেশের শাসনভার পরিচালনা করবে। যেহেতু দেশের সব মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয় তাই সংবিধান দেশের জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অংশ জনগণের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। অন্য অংশটি জনগণের হয়ে দেশ পরিচালনাকারীদের ভুলত্রুটি সংশোধন করবে; স্বেচ্ছাচারী শাসকদের জবাবদিহি করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করবে। তারা বিভিন্নভাবে জনগণের মতামত তুলে ধরে শাসনকার্যে দিক-নির্দেশনা দেবে। অর্থাৎ জনগণ শুধু সরকার গঠনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অংশগ্রহণ করবে।
উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা লক্ষণীয়। এ পদ্ধতির সফল বাস্তবায়নের প্রথম শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচনের পর সবচেয়ে যেটি বেশি প্রয়োজন তা হলো কার্যকর একটি সংসদ। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। কোনো দেশ যখন যথার্থই গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তখন সে দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকে না। সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত থাকে। অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের মূলোৎপাটিত হয়। মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।
আজ দেশের স্বাধীনতার বয়স ৫৪ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু বিগত দুই দশকে দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চিত্র মোটেই সুখকর ছিল না। ১৯৯১ সালে দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশ থেকে আবার গণতন্ত্রের বিদায় ঘটে। ওই বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল হাস্যকর, ভোটারবিহীন নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাও ছিল পূর্ব-নির্ধারিত। ২০১৮ সালেও একইভাবে ভোটারবিহীন হাস্যকর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কফিনে সর্বশেষ পেরেক মেরে দেয়া হয়। কথিত সংসদ সদস্যরা বিনাভোটে নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনও কার্যত ছিল একইরকম। জনগণ ক্ষমতার মালিক হলেও তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালকদের নির্বাচন করতে পারেনি। তাদের ভোটাধিকার ছিনতাই করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, দেশের এই অগণতান্ত্রিক ধারায় চলার পেছনে সব সময় মদদ জুগিয়েছে ভারত।
ভারত শুরু থেকেই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে নাক গলিয়েছে। দেশটির প্রত্যক্ষ কারসাজিতে আমাদের গণতন্ত্র লুটপাটতন্ত্রে পরিণত হয়। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পৈতৃক সম্পদে পরিণত করেন। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে দেশে গুম ও খুনের সংস্কৃতি চালু করেন। বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে টর্চার করার জন্য ‘আয়নাঘর’ বানান। দেশ থেকে একদিকে গণতন্ত্র নির্বাসিত, অন্যদিকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার উধাও হয়ে যায়। ফলে দেশ গভীর সঙ্কটে নিপতিত হয়। তারপরও ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের গলাবাজি থেমে ছিল না। ক্রমেই রাজনৈতিক মাফিয়াদের বীভৎস চেহারা প্রকাশ পেতে থাকে। আখের গুছাতে ব্যস্ত সময় পার করছিল স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে দেশের বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করে।
শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করেছিল দানবীয় এক গোষ্ঠীতন্ত্র। এ গোষ্ঠীতন্ত্র ঘিরে সৃষ্টি হয় জমজমাট নমিনেশন বাণিজ্য। এ বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার লেনদেন ছিল প্রকাশ্য। ঘুষ লেনদেনের সাথে জড়িত এসব নেতাই আবার সততার নসিহত করত। তারাই আবার গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেজে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়াত! মানুষ ধারণা নিয়েছিল, রাজনীতি মানেই হলো জোর-জালিয়াতি করে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া। রাজনীতি মানেই সাধারণ জনগণের সম্পদ লুটপাট করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া। এ কারণে সাধারণ মানুষ রাজনীতিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
জনগণ এ অস্থির রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত ছিল শুরু থেকেই। একাত্তরের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল হাসিনার সাঙ্গোপাঙ্গরা। এত সব অসঙ্গতির মধ্যেই উন্নয়নের মিথ্যা ফানুস ওড়ানো হচ্ছিল। উন্নয়নের ভ্রান্তিবিলাসে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছিল দেশবাসীকে। চরম অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতার সাথে দেশ চালাচ্ছিল শেখ হাসিনা। তাদের এই দুঃশাসন শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বিএনপি-জামায়াতসহ গণতান্ত্রিক দলগুলো। কিন্তু তাদের রাজপথে দাঁড়াতে দেয়নি আওয়ামী সরকার। তারা অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছিল বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর। গুম, খুন ও হত্যা ছিল আওয়ামী সরকারের নিত্যদিনের কর্মসূচি।
তারা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর আওয়ামী সিন্ডিকেটে পরিণত করে। আর এটিকে দানবীয় আকারে রূপ দিতে সহায়তা করে মিডিয়া সিন্ডিকেট। দেশবরেণ্য আলেমদের কারাগারে অন্তরীণ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। শত শত আলেমদেরকে শাপলা চত্বরে হত্যা করা হয়।
গণতান্ত্রিক দলগুলো আওয়ামী হায়েনাদের বিরুদ্ধে কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছিল না। ঠিক এমন সময় এগিয়ে আসে দেশের তরুণ প্রজন্ম। তারা তারা হাসিনার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলার জনগণকে জাগিয়ে তোলে। আর সে কারণেই স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় নতুন স্বাধীনতা ২০২৪। তাদের বিপুল আত্মত্যাগে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তারা অর্পণ করে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে।
কিন্তু স্বৈরাচারীরা বসে নেই। দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে এ স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র। আর এ ষড়যন্ত্রের পেছনের একমাত্র কারিগর সেই আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত। দেশটি এক ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে পরিত্যাগ করেছে।
ঠিক এই মুহূর্তে দেশের ভেতের-বাইরে যে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে দেশবাসীর তা জানা। ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কেও দেশবাসী অবগত। এ ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয় ছাত্র আন্দোলনের অকুতোভয় বীর হাসানাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। তার এই সাহসী পদক্ষেপ পুরো বাংলাদেশকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়েছে চব্বিশের বীর সৈনিকরা। তাদেরকে বশে আনতে নানানভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রলোভন দেয়া হচ্ছে। এ মতলববাজরা একটি দলকে ক্ষমতায় এবং আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে বসাতে চাচ্ছে। তরুণদের কিছু আসন দিয়ে খুশি রাখা এবং ইসলামপন্থী বিশেষত জামায়াতে ইসলামীকে সংসদের বাইরে ঠেলে দিতে চাচ্ছে।
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, চক্রটি নতুন করে ফ্যাসিবাদ ফিরিয়ে আনতে তৎপর। এই যখন অবস্থা তখন দেশের রাজপথ নানা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতা নতুন করে সংগঠিত হতে শুরু করেছে। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
এদিকে একটি গ্রুপ ডক্টর ইউনূসের পদত্যাগ দাবি করছে। আরেকটি গ্রুপ দ্রুত নির্বাচন চাইছে। মূলত ভারত বাংলাদেশে একটি গৃহযুদ্ধ দেখতে চাইছে। তারা গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ তৃতীয় শক্তির উত্থান দেখতে চায়।
সবকিছু ঠিক থাকলে আজ প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে যাচ্ছেন। কিন্তু ভারত কখনো চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায় না। তারা বাংলাদেশের অধীনতা চায়। যা বাংলাদেশের জনগণ কখনো মেনে নেবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত নিজের স্বার্থেই সহযোগিতা করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হোক, স্বাধীনভাবে রাজনীতি করুক কোনোটিই ভারত চায় না। তারা বাংলাদেশকে তাদের কলোনি করে রাখতে চায়। বাংলাদেশের মানুষকে ভারত তার অধীনস্থ দাস হিসেবে দেখতে চায়। দেশের তরুণ প্রজন্ম তা আর কখনোই হতে দেবে না। তারাই রক্ষা করবে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া