বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ ও ‘আবাবিল’

ইহুদিদের বিরুদ্ধে শুধু ঘৃণা নয়, আমাদের প্রয়োজন নিজেদের দিকে ফিরে দেখা। কুরআনের নির্দেশনায় ফিরে যাওয়া, প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, জ্ঞান ও কৌশলে সমৃদ্ধ হওয়া। যত দিন মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত থাকবে, যত দিন আমরা অলস ও ভোগবিলাসে মত্ত থাকব; তত দিন ‘আবাবিল’ আর আসবে না। আর তত দিন আমাদের ভাইয়েরা, ফিলিস্তিনে, ইয়েমেনে, কাশ্মিরে, রোহিঙ্গা শিবিরে কাঁদতেই থাকবে।

গাজা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শিশুদের কাটা পা, বিধ্বস্ত হাসপাতাল আর অনাহারে ক্লান্ত মানুষের কাতর মুখ- এই দৃশ্য যেন প্রতিদিনই আমাদের সামনে হাজির হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে ধনী আরব দেশগুলো কী করছে? তারা কি শুধু নিন্দা ও উদ্বেগের বাণী ছাড়া কিছুই দিতে পারছে না? আমাদের ভেতরে আজ প্রশ্ন জাগে, আল্লাহর সেই ‘আবাবিল’ বাহিনী কই? আজ কেন সেই অলৌকিক সাহায্য আসছে না?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কুরআনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে, নিজেদের দোষ খুঁজতে হবে এবং বুঝতে হবে আল্লাহর সাহায্য আসে ঈমান ও আত্মত্যাগের মহিমায়- কথায় নয়, কিন্তু কর্মের মাধ্যমে।

কুরআনের নির্দেশনা : বন্ধুত্ব নয়, সচেতনতা

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদেরকে বন্ধু বানায়, তবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আল মায়িদা-৫ : ৫১)

এই আয়াত কোনো বিদ্বেষমূলক বার্তা নয়; বরং এটি মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক বাস্তবতার এক গভীর সতর্কবার্তা। যারা তোমার দখল চায়, যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের সাথে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা আত্মঘাতী। অথচ আজ বহু মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। তাদের এই অবস্থান কেবল কুরআনের নির্দেশনার বিরুদ্ধেই নয়; বরং ফিলিস্তিনের শহীদ রক্তের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা।

ইহুদিদের জ্ঞান ও পরিকল্পনা : কুরআনের স্বীকৃতি

‘আমি তো জ্ঞান দিয়ে তাদেরকে (ইহুদিদের) দুনিয়ার জাতিগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছিলাম।’ (সূরা আদ-দুখান-৪৪ : ৩২)

এখানে কুরআন ইহুদিদের একসময়কার শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানভিত্তিক অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজো তারা এই জ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে বিশ্ব মিডিয়া, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক অঙ্গনে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করছে।

তবে তাদের অবাধ্যতা, চুক্তিভঙ্গ ও অহঙ্কারের জন্য কুরআন তাদের অভিশপ্তও ঘোষণা করেছেÑ ‘আল্লাহর হাত বাঁধা, এ কথা তারা বলে। তাদের কথা তাদেরই বিরুদ্ধে গেল; বরং আল্লাহর হাত প্রশস্ত, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। তাদের কৃতকর্মের কারণে তারা হয়েছে অভিশপ্ত।’ (সূরা আল-মায়িদা-৫ : ৬৪)

মুসলমানদের বিভ্রান্তি ও অলৌকিকতার আশা

আজ মুসলমানদের একটি বড় অংশ মনে করে, ঠিক যেমন অতীতে আবাবিল পাখিরা এসেছিল, তেমনিভাবে আজকেও অলৌকিক কিছু ঘটবে। কিন্তু তারা ভুলে যায় আল্লাহর সাহায্য আসে তাদের জন্য, যারা নিজেরা চেষ্টা করে।

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন করে।’ (সূরা আর-রাআদ-১৩ : ১১)

আবাবিলের কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয়, কিভাবে দুর্বল মক্কাবাসীর পাশে আল্লাহ দাঁড়িয়েছিলেন- ‘তুমি কি দেখোনি, তোমার প্রতিপালক কিভাবে হাতি-অভিযানকারীদের সাথে আচরণ করেছিলেন?... তিনি তাদের ওপর দলবদ্ধভাবে আবাবিল পাখি পাঠিয়েছিলেন।’ (সূরা ফিল-১০৫ : ১-৩)

কিন্তু আজ? আমরা কি আত্মত্যাগ করছি? আমরা কি ঐক্যবদ্ধ? না; বরং আমরা বিভক্ত, বিলাসিতায় নিমজ্জিত ও নেতৃত্বহীন।

বিলাসিতা ও নেতৃত্বের অভাব : আরব রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা

আজকের আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেক শাসক পশ্চিমা শক্তির সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চরম অবমাননা করছে। তারা ইসরাইলকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, নিজের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের সমর্থনে নির্ভর করছে।

‘তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের চেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথে বাধা দেয়।’ (সূরা ইবরাহিম-১৪ : ৩)

এসব শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা, বিলাসবহুল জীবন ও আত্মরক্ষার জন্য উম্মাহর রক্তকে ত্যাগ করছে। মুসলিম জনগণ আজ নিঃস্ব, অথচ শাসকগোষ্ঠী পশ্চিমা অস্ত্র কেনা আর রাজকীয় জীবন নিয়ে ব্যস্ত।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের নতুন পর্ব : যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ

২০২৫ সালের জুনে ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বড় ধরনের বিমান হামলা চালিয়েছিল। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান শতাধিক ড্রোন ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়ে। তখনো যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও ইসরাইলকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। কিন্তু ২২ জুন ২০২৫, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়। এই হামলা প্রমাণ করে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে একত্রে মুসলিম বিশ্বকে চাপে রাখার নীতি অবলম্বন করছে। আরব রাষ্ট্রগুলো এখনো নীরব, মুসলিম নেতৃত্ব অদৃশ্য। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা- মুসলিম বিশ্বের যদি সমন্বিত প্রতিক্রিয়া ও দূরদর্শী নেতৃত্ব না থাকে, তাহলে আগামীতে আরো জটিল সঙ্কট সৃষ্টি হবে।

ঐক্য ছাড়া মুক্তি নেই

‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান-৩ : ১০৩)

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ চালাচ্ছে। অথচ মুসলিম বিশ্বের বড় অংশ কেবল তামাশা দেখছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোনো মুজিজা, কোনো আবাবিল, কোনো অলৌকিকতা মুসলমানদের উদ্ধার করবে না। আল্লাহর সাহায্য আসে আত্মত্যাগের ও ঈমানের ভিত্তিতে।

উপসংহার : ইহুদিদের বিরুদ্ধে শুধু ঘৃণা নয়, আমাদের প্রয়োজন নিজেদের দিকে ফিরে দেখা। কুরআনের নির্দেশনায় ফিরে যাওয়া, প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, জ্ঞান ও কৌশলে সমৃদ্ধ হওয়া।

যতদিন মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত থাকবে, যতদিন আমরা অলস ও ভোগবিলাসে মত্ত থাকব, ততদিন ‘আবাবিল’ আর আসবে না। আর ততদিন আমাদের ভাইয়েরা, ফিলিস্তিনে, ইয়েমেনে, কাশ্মিরে, রোহিঙ্গা শিবিরে কাঁদতেই থাকবে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য, বিইউপি