বিশ্বাস থেকে যে সাহসের উৎপত্তি হয় তা মানুষকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। কেননা মানুষ বিশ্বাসের জন্য জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। এবারের পাক-ভারত যুদ্ধের ঘটনাবলী দেখে তাই মনে হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের আকাশ যোদ্ধারা অপেক্ষাকৃত অনেক বড় শক্তির বিরুদ্ধে যে সাহস দেখিয়েছেন তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছে। সবাই ভাবছেন এটা কিভাবে সম্ভব হলো? বিশ্বের সব সামরিক বিশেষজ্ঞ স্তম্ভিত।
এ যুদ্ধের সময় আমরা এমন কিছু ফুটেজ দেখেছি, তা যদি সত্যি হয় তাহলে আবেগে আপ্লুত হওয়ার অনেক কারণ আছে। যেমন একটি ফুটেজের ক্যাপশনে দেখা গেছে, পাকিস্তানে জঙ্গিবিমানের একজন পাইলট শেষ চিঠি লিখছেন। তাতে তিনি কী লিখেছিলেন সে কথা আমরা জানি না। তবে এটা বুঝতে পারা যায়, তিনি তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কিংবা গোটা জাতিকে উদ্দেশ করে চিঠির মাধ্যমে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন। কী এক সাহস এসে তার মাথায় ভর করেছিল! তিনি জানেন এটিই তার শেষ যাত্রা। এ রকম মুহূর্তে নির্বিকারচিত্তে এভাবে শেষ চিঠি লেখা সত্যি অসাধারণ সাহস ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ মনে করেন তিনি একা নন। তার সাথে আছেন আল্লাহ। কেউ যদি দৃঢ়তার সাথে এই বিশ্বাস করেন, পথ যতই দুর্গম হোক না কেন, আল্লাহ তার সাথে আছেন; তাহলে তার পক্ষে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়াও সম্ভব।
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সেই তরুণীদের কথা একবার ভাবুন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিশ্বাসে তাদের এমন এক সাহসী যোদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিল যে, তারা খালি হাতে পুলিশের গুলির সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে সেই পুলিশ অফিসারের কথা, যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলছিল, গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।’ কামাল এবং তার সঙ্গীরা কিংবা ওই সব পুলিশ অফিসারের ওই তরুণদের সাহসকে একটু বোঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল। তবে সত্যটা হচ্ছে, ফ্যাসিস্টরা কখনো তা বোঝার চেষ্টা করে না।
ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং দেশটির অভ্যন্তরে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ উভয় ক্ষেত্রে পাকিস্তানের আকাশযোদ্ধারা এমন এক সাহস ও নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন, তা গা শিউরে ওঠার মতো। তবে যুদ্ধ কোনো আনন্দের বিষয় নয়। বিজয়ীরা আনন্দ উৎসব করেন ঠিকই; কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই টের পান বাস্তবতা কত কঠিন।
আজ কঠিন বাস্তবতা এটাই যে, ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ দিন দিন গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক এলিটদের সহায়তায় ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছেন করপোরেট এলিটরা। আদানি, আম্বানিরা। সাম্প্রতিক সময়ে বিবিসির এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের ১৪৫ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। পাকিস্তানের অবস্থা একই রকম। সেখানে ফিউডাল এলিটদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের নিষ্পেষণে জনগণের এখন ত্রাহি অবস্থা। এ কারণে পাকিস্তানের সমাজ আজ বহুধাবিভক্ত। একদিকে ফিউডাল শাসকচক্র; অন্য দিকে দুঃখ ও দুর্দশাপীড়িত মানুষের হাহাকার।
ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ নাভারন গত ১২ মে পুনেতে এক বক্তৃতায় বলেছেন, যুদ্ধ বোম্বের কোনো রোমান্টিক সিনেমা নয়। যুদ্ধ মানে ধ্বংস, যুদ্ধ মানে জনগণের ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসা। ভারতের একজন সাবেক সেনাপ্রধানের মুখ থেকে যুদ্ধবিরোধী এ মন্তব্য এই বার্তা দেয় যে, ভারত অতীতে কিংবা বর্তমানেও যেসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল বা পড়ছে, তা কখনো জনগণের কল্যাণে ছিল না। বিশেষ করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যে যুদ্ধ পরিচালিত হয় তা ধ্বংস ছাড়া আর কিছু বয়ে আনে না। যেমন-জার্মানের হিটলার জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সেটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যে যুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, যে যুদ্ধ শুধু ধ্বংস সাধন করেনি; জার্মান দেশটাকেও দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল।
আজ যেমন এক দিকে হিন্দুত্ববাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মোদি সরকারের আগ্রাসন; অন্য দিকে পাকিস্তানের সামন্তবাদী চক্রের নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে যুদ্ধ শেষ হাতিয়ার। সত্য যদি এসব যুদ্ধ ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হয়ে থাকত; তাহলে সত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকত। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারত যতবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে; ততবার দেখা গেছে, ভারতের কোনো না কোনো নির্বাচনের আগে এটি সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ জাতি নয়, যুদ্ধকে নির্বাচনে জয়লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এবারো বিহারের নির্বাচন সামনে রেখে পাকিস্তানের ওপর এ আগ্রাসন চালানো হয়েছে। এতে দুঃখ, দুর্দশা ও সীমাহীন কষ্ট নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের ওপর।
পাকিস্তানের বিষয়টি ঠিক একই রকম। একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদের হিমশিম খেতে হবে। যেমন- ধরুন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসীম মুনির ১৭ এপ্রিল যে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে ভারত অধিকৃত কাশ্মির ইস্যু নিয়ে সুস্পষ্ট একটা ইঙ্গিত ছিল। তিনি বলেছিলেন, সংগ্রামরত কাশ্মিরি জনগণকে কখনো আমরা পরিত্যাগ করব না। কাশ্মির হচ্ছে আমাদের,‘জগুয়ার শিরা’। কিন্তু সে ব্যাপারে সামান্যতম কোনো অর্জন ছাড়া দ্রুত মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, তা হচ্ছে: এ যুদ্ধের সময় ইমরান খানকে মুক্তি দিয়ে ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার যে সুযোগ এসেছিল তা কাজে লাগানো হয়নি। এতে বুঝা যায়, জেনারেল আসীম মুনির, জারদারি, নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফ শাসকচক্রের জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে সেনাপ্রধানের ওই আবেগের ভাষণ ও পরবর্তী যুদ্ধের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আর এসব অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধ সব সময়ে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে।
ইতোমধ্যে ভারতে সাধারণ মানুষজন যেমন যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে; তেমনি বিরোধী দলসমূহ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে মোদির কারণে কাশ্মির ইস্যু আন্তর্জাতিকীকরণ হওয়া, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া, আবার কাশ্মির ইস্যুতে তৃতীয়পক্ষের আগমনের আশঙ্কায় বিরোধী দলগুলোর নেতারা মোদিচক্রকে বেশ চেপে ধরেছে। এসবের চেয়েও বড় বিষয়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হলেও এ যুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিরপক্ষ অবস্থান নেয়ায় মোদির কূটনৈতিক ব্যর্থতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে; যা মোদিবিরোধীদের রাজপথে নামার পথ প্রশস্ত করেছে।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি হলেও তা কত দিন স্থায়ী হবে সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে কোণঠাসা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ভাষণে বলেছেন, যুদ্ধ শেষ হয়নি, বন্ধ রাখা হয়েছে। এ থেকে এটা বোঝা যায়, হিন্দুত্ববাদী মোদিচক্র বেশি চাপে পড়ে গেলে আবারো যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে। সে আশঙ্কা আছেই। তাই যুদ্ধ বিরতি-উত্তর দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী পরিস্থিতি কোন দিকে প্রবাহিত হবে।