বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তৈরি করছে নানা সঙ্কট। যত দিন যাচ্ছে সঙ্কট বাড়তে থাকবে। তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মাঝখানে আলোচনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টিকে আবার আলোচনায় এনেছেন। জাতি আশা করে, প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গারা আদৌ মিয়ানমারে ফিরতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য কমে আসছে। রোহিঙ্গারা যেন মর্যাদার সঙ্গে এবং স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে পারে সে জন্য বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় জন্মভূমি হিসেবে কল্পনা করছে। যারা ক্যাম্পে আছে তারা দিন কাটাচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে। এ সুযোগে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
পৃথিবীর কোনো দেশেই অন্য দেশের নাগরিক অবৈধভাবে চলাফেরা করতে পারে না। আমাদের দেশ এ ক্ষেত্রে দিয়েছে উদারতার পরিচয়। জনবহুল এ দেশের শ্রমবাজার খুবই সঙ্কীর্ণ। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা স্রোত আমাদের শ্রমবাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এদের অধিকাংশই এ দেশে স্থায়ী বসবাস করছে। কিছু স্বার্থান্বেষী টাকার বিনিময়ে তাদেরকে সহায়তা করে মৎস্যশিকার, ব্যবসায়ে সহযোগী, স্থায়ী কর্মচারীসহ নানা কাজে ব্যবহার করছে। স্থানীয় হোটেল রেস্টুরেন্টে, রিকশাচালক, দিনমজুর, কুলি, শ্রমিক হিসেবে কাজ করে পরবর্তীতে লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্র করে একটি সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে ভারত ও চীনের সমর্থন পেতে রোহিঙ্গাদের বোঝা টেনে নিয়েছিল। রাখাইন এলাকায় রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানে ভারত নীরব সমর্থন দিয়েছিল। মানবিক সাহায্য কমে আসায় রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিগত সরকার সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে আন্তরিকভাবে যুক্ত হয়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তাদের লক্ষ্য ছিল না। যার ফলে শরণার্থীদেরকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবির পরিদর্শনের মাধ্যমে আবারো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্ব পাবে। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা শিশু। তাদের পরিচর্যা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষার ব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যয় দিন দিন অনেক বাড়ছে।
স্থানীয় চাকরির বাজারেও এদের প্রভাব পড়েছে। শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমের মূল্য কমেছে। ফলে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মাদক ও মানবপাচারের মতো বিভিন্ন সীমান্ত অপরাধ বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও বৃহত্তর পরিসরে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
এ প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সঙ্কটে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আসন্ন পর্যটন মৌসুমেই এর প্রভাব স্পষ্ট হবে। নিরাপত্তার সঙ্কট তৈরি হলে কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রেও তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়নের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। এসব প্রকল্পে বড় ধরনের দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়, তবে তা প্রকল্পগুলোতে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন, ভারত ও রাশিয়াকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করা।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইফতারে অংশ নেন। এতে রোহিঙ্গারা তাদের ওপর গণহত্যা বন্ধ করা ও তাদেরকে নিজ দেশে ফেরানোর দাবি জানান। পরে প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের কিভাবে দ্রুত তাদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা যায়, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ধারা, তা অনেক ঈর্ষণীয় এবং অনেক দেশের তুলনায় তা অনেক এগিয়ে। এ দেশের যে প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ রয়েছে তা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কথা বলা হচ্ছে, তা অর্জনে কোনো বাধা থাকবে না। যারা আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে পক্ষাবলম্বনে ইতস্তত করছে, তাদের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক বিনির্মাণ প্রয়োজন।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। রাখাইন রাজ্যের এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সরকার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। বৈষম্য, নিপীড়ন ও সহিংসতার কারণে তারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হলো নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার