মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, বর্তমানে জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে দেশটি একদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করছে।

এলামী মো: কাউসার, কায়রো (মিশর)
মিশরের পিরামিড
মিশরের পিরামিড |ইন্টারনেট

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, বর্তমানে জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে দেশটি একদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। এই প্রতিবেদনে মিশরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি

২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট সিসির শাসনব্যবস্থা কঠোর শাসনব্যবস্থা ও দমননীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিসি ৮৯ দশমিক ছয়ভাগ ভোট পেয়ে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন। তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতর্কিত ছিল, কারণ বিরোধী প্রার্থীদের অংশগ্রহণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, বিশিষ্ট বিরোধী নেতা আহমেদ তানতাওয়ি প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে প্রচারণা স্থগিত করেন। পরে তাকে ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে বিবেচিত হয়। সিসির শাসনামলে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।

২০২৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে প্রমাণ ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদী হেফাজতে রাখা হচ্ছে। এছাড়া, সামরিক আদালতে বেসামরিক নাগরিকদের বিচার এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। সরকার ২০২২ সালে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নিলেও, এটি কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কার আনতে পারেনি।

২০২৫ সালের সংসদীয় নির্বাচন মিশরের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই নির্বাচনে ৫৯৬টি আসনের মধ্যে ৫৬৮টি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ হবে, বাকি ২৮টি রাষ্ট্রপতির মনোনয়নে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুবক, নারী, খ্রিষ্টান এবং শ্রমিকদের জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ রয়েছে। বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী আলা আবদেল ফাত্তাহের কারাবন্দিত্ব এবং তার মা লায়লা সুয়েফের অনশন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

মিশরের অর্থনীতি বর্তমানে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা আঞ্চলিক সঙ্ঘাত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ নীতিগত ত্রুটির ফল। ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৩৯ দশমিক ৭%-এ পৌঁছায়, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মিশরীয় পাউন্ডের ৪০ ভাগ মূল্যহ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি অর্থনৈতিক চাপকে আরো বাড়িয়েছে। গাজা যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরে হুথি হামলার কারণে সুয়েজ খালের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা মিশরের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা। এছাড়া পর্যটন শিল্প, যা জিডিপির ২৪ ভাগ অবদান রাখে, আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০২৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং আইএমএফ-এর আট বিলিয়ন ডলারের ঋণ মিশরকে সঙ্কট থেকে উদ্ধারে সহায়তা করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই আর্থিক সহায়তা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়। সিসির নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক আধিপত্য বেসরকারি খাতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিমেন্ট, ইস্পাত ও রিয়েল এস্টেটের মতো লাভজনক খাতে প্রভাব বিস্তার করছে, যা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতিযোগিতার সুযোগ সীমিত করছে। আইএমএফ সামরিক প্রভাব কমানো এবং স্বচ্ছতা বাড়ানোর পরামর্শ দিলেও, এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি ধীর।

সামাজিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ

অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক দমননীতির কারণে জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। ২০২২ সালে ৬৮ ভাগ জনগণ খাদ্য কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের অভাবের কথা জানিয়েছে, যা সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা ২০১১ সালের আরব বসন্তের স্মৃতি ধারণ করে, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে।

মিশরের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বেসরকারি খাতের প্রসার, সামরিক প্রভাব হ্রাস এবং স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা অপরিহার্য। রাজনৈতিকভাবে, বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং বাকস্বাধীনতার সুযোগ বাড়ানো গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি। আঞ্চলিক সংঘাতের প্রভাব কমাতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মিশরকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে।

বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সহযোগিতা

মিশর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে, যার আওতায় ২০২৫ সালে এক বিলিয়ন অর্থায়ন পেয়েছে। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে রাস এল-হিকমা প্রকল্পে ৩৫ বিলিয়ন বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট লাঘবে সহায়ক হবে।

মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গভীর সঙ্কট এবং সম্ভাবনার দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। সিসির শাসন ব্যবস্থা স্বল্পমেয়াদী স্থিতিশীলতা আনলেও, দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধির জন্য সাহসী সংস্কার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ নীতি সংশোধনের মাধ্যমে মিশর এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে এর জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও জনগণের আস্থা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।