দৈনিক নয়া দিগন্তের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হলো গত ২৫ অক্টোবর। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যেটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো তা হলো, পত্রিকাটি তার ২১ বছরের জীবনের ১৭ বছর কাটিয়েছে ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে। এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, পত্রিকাটির মালিক, সাংবাদিক ও অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীরা কতটা ধৈর্য, সহনশীলতা ও কৌশলের সাথে কাজ করেছেন। তাদের এ সাহসিকতা ও ধৈর্য কৃতিত্বপূর্ণ যা প্রশংসার দাবি রাখে। অথচ এ সময়ের মধ্যে পত্রিকাটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘দিগন্ত টিভি’ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল হেফাজত হত্যাকাণ্ডের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সম্প্রচারের অপরাধে।
২০০৪ সালে যখন নয়া দিগন্তের আত্মপ্রকাশ ঘটে তখন আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি ছিলাম। সূচনাপর্বে যেসব সাংবাদিক এ পত্রিকা প্রকাশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের সবাই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। তাদের অনেকে এখনো কর্মরত আছেন, অনেকে অন্য পত্রিকায় চলে গেছেন। আমার সাংবাদিক জীবনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালাহউদ্দিন বাবর এখন পত্রিকাটির সম্পাদক। এ ছাড়া অত্যন্ত প্রিয়জন সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী নির্বাহী সম্পাদক।
পত্রিকাটির শুরুতে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকে অবসর নিয়েছেন আবার অনেকে অন্যত্র আরো মর্যাদার সাথে কাজ করছেন। যেমন আযম মীর এখন দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক। মনজুরুল ইসলাম দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক। আলফাজ আনাম দৈনিক আমার দেশের সহযোগী সম্পাদক। মোতালেব জামালী আমার দেশে সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। হারুন জামিল অনলাইন পোর্টাল ‘বাংলা মেইল’-এর নির্বাহী সম্পাদক। এ ছাড়া যারা শুরু থেকে কাজ করে আসছেন তাদের মধ্যে খাইরুল বাশার এখন নয়া দিগন্তের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। মুজতাহিদ ফারুকী সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। যদিও তিনি শুরু করেছিলেন ফিচার সম্পাদক হিসেবে। ছিলেন আমার দেশের বার্তা সম্পাদকও। আবু সালেহ আকন বর্তমানে পত্রিকাটির চিফ রিপোর্টার। জাকির আবু জাফর শুরু থেকে পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে নয়া দিগন্তের সাংবাদিক-কর্মচারীরা ধৈর্য ও কৌশলের সাথে টিমটিম করে পত্রিকাটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেও ওই সময়ে রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে অনেক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, চ্যানেল-ওয়ান টিভি, ইসলামী টিভিসহ আরো অনেক মিডিয়া। শুধু তাই নয়, অনেক মিডিয়ার মালিককে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। যেমন ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ফ্যাসিস্ট সরকার তার পত্রিকাটি বন্ধ করে ক্ষান্ত হয়নি, জেল-জুলুম খাটিয়ে তার ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তিনি বিদেশে নির্বাসন জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
অসম্ভব সাহসী মাহমুদুর রহমান তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মূলত দৈনিক নয়া দিগন্তে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে। তাই তিনি নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ভোলেননি। আর নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেম আলীকে তো বিচারিক হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
তাই গত শনিবার শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ফ্যাসিবাদমুক্ত একটি পরিবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। নাট্যকলা মিলনায়তনে প্রবেশ করতে দেখলাম আমার সম্পাদক বন্ধু রজনীগন্ধার স্টিক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। আমাকে একটি রজনীগন্ধার স্টিক ধরিয়ে দিয়ে ভালোবাসার যে উষ্ণতা প্রকাশ করলেন তা অভিভূত হওয়ার মতো।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা অসামান্য সাহসী পুরুষ শহীদ মীর কাসেম আলীর কথা। ফাঁসিতে মৃত্যু হতে পারে জেনেও তিনি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন নিজ দেশে। অনেকে মনে করেন, সে সময় বিদেশে থেকে গেলে হয়তো তাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। আসলে নিয়তির লিখন কে খণ্ডাবে? তবে তার বিদেশ থেকে ফিরে আসা এবং হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার ঘটনা অনেকের হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে।
মীর কাসেম আলীর সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন তিনি ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডে ১৪ নম্বর বাড়িতে একটি অফিসে নিয়মিত বসতেন। সেটি ছিল রাবেতা আলমে ইসলামীর অফিস। ওখানে পরিচয় হয়েছিল আমীর হামযার সাথে, যিনি এখন নয়া দিগন্তের সহকারী সম্পাদক। তারপর বহুবার মীর কাসেম আলীর সাথে দেখা হয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় তার বিশ্বাসের দৃঢ়তায় অবাক হয়েছি।
তিনি সত্যি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ছিল দৃঢ় মনোবল। একদিন এক আলোচনায় ১৯৬৯ সালে শহীদ আব্দুল মালেকের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মালেক ভাইয়ের মতো দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন। যখন মালেক ভাই বলতেন, ‘আমার পা কেটে ফেললে বুক ও হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। আর যদি দুই পা ও দুই হাত কেটে ফেলে তাহলে শুধু বুক দিয়ে সামনে যাব। তবুও সামনে যেতে থাকব।’ এ উদাহরণটি দিয়ে তিনি তার মনোবলের দৃঢ়তা প্রকাশ করেছিলেন। তাই নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বার বার মীর কাসেম আলীর কথা মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম, তাই হয়তো তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন এবং ফাঁসির মঞ্চে শহীদ আব্দুল মালেকের দৃষ্টান্ত যেন অনুসরণ করে গেলেন।



