ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আপাতত অবসান

অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবারো ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক য্দ্ধু থেকে সরে আসায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু এর মধ্যে বেশ কিছু নিরপরাধ মানুষের জীবন ঝরে পড়ার দায় কে নেবে? নিশ্চয় এটি যে ভারতের বাড়াবাড়িতে হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই

অবশেষে উপমহাদেশের চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা আপাতত প্রশমিত হয়েছে। গতকাল দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ আলোচনার পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল শনিবার এক্স হ্যান্ডলে এ কথা জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। শুভবুদ্ধির ব্যবহার করে দুই পক্ষ এ সিদ্ধান্তে আসায় উভয় দেশকে অভিনন্দন।’ ট্রাম্পের এ ঘোষণার পরপর পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষ থেকেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কথা জানানো হয়। দুই দেশই জানায়, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।

এর আগে পাকিস্তান যেভাবে বলেছিল ঠিক সেভাবে ভারতের ওপর প্রতিশোধমূলক পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানের নেতারা বলেছিলেন, তারা রাতের আঁধারে কাপুরুষের মতো আক্রমণ চালাবেন না। দিনের বেলায় এমন এক আক্রমণ চালাবে, যা বিশ্ববাসী দেখবে। কথামতো পাকিস্তান ১০ মে শনিবার ফজরের নামাজের পর পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় ব্রহ্মা ক্ষেপণাস্ত্রের গুদাম, রাশিয়ার তৈরি এস ৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটি। এ ছাড়া পাকিস্তান সাইবার আক্রমণে হ্যাক হয় বিজেপির ওয়েবসাইট। জ্যাম করে দেয়া হয় ভারতের সামরিক স্যাটেলাইট।

যুদ্ধের ধরন দেখে মনে হয়েছিল, উভয়পক্ষ একটি সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; অর্থাৎ এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয় ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের কল্পিত পৌরাণিক শক্তির বাস্তব রূপ দেখা যাবে; না হয় পরাজয়ের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারত গঠনের কল্পনা ধুলোয় মিশে যাবে।

প্রথম পর্বের আকাশযুদ্ধে ভারত শোচনীয়ভাবে ধরাশায়ী হয়। এটি ছিল ৭ মের শেষ রাতের ঘটনা। ভারতের বিমানবাহিনী রাতের আঁধারে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানে হামলা চালায়। শুরু হয়ে যায় আকাশযুদ্ধ। ওই রাতে বিশ্ববাসী এমন এক ডগ ফাইটের অভিজ্ঞতা অর্জন করল, যা অতীতে আর কখনো সংঘটিত হয়নি; অর্থাৎ এটি ছিল ভয়াবহ এক আকাশযুদ্ধ।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর ইতালির একটি বিমান থেকে অটোমান বাহিনীর ওপর বোমা হামলার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধবিমান ব্যবহার শুরু হয়। তার পর প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছাড়াও কত যুদ্ধে হয়ে গেছে এর কোনো হিসাব নেই। এসব যুদ্ধের চাঞ্চল্যকর সব ডগ ফাইটের ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু মানব ইতিহাসে এত বড় ডগ ফাইটের ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। ভারতীয় সূত্র মতে, সেই রাতে ভারত ৮০টি জঙ্গিবিমান নিয়ে পাকিস্তানে আক্রমণ চালিয়েছিল। পক্ষান্তরে, মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান ১২৫টি জঙ্গিবিমান নিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছিল। এটি ছিল অবিস্মরণীয় এক বিমানযুদ্ধের ঘটনা। কারণ ভারত আক্রমণ করার মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণে ভারত দিশেহারা হয়ে পড়েছিল।

পাকিস্তানের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আক্রমণ করার ধরন দেখে বোঝা যায়, দেশটি আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। বিশেষ করে কাশ্মিরের পহেলগামে ‘ফলস ফ্লাগ অপারেশনের’ পর এটি কারো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার পাকিস্তানে হামলা চালানোর একটি বাহানা তৈরি করে। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। ৭ মে শেষ রাতে পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে ভারত বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছিল, ভারতের সামরিক শক্তি সব কল্পনা ছাড়িয়ে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা পৃথিবীর যেকোনো শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উল্টোটি। কপালে গ্লানি ছাড়া আর কিছু জুটল না ভারতের।

ভারতের এ গ্লানির আঁচ ফরাসিদের গায়েও লেগেছে। কারণ অদক্ষ ভারতীয় পাইলটদের কারণে ফ্রান্সের তৈরি ৪ দশমিক ৫ জেনারেশনের অত্যাধুনিক রাফাল জঙ্গিবিমানের শেয়ার দর ২১ শতাংশ কমে গেছে। এতে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব যেমন বিব্রত হয়েছে, তেমনি বিব্রত হয়েছে ফরাসি সরকার। এর জেরে ফরাসি সরকার তার বিমানগুলো ফেরত চায়। মূলত যুদ্ধক্ষেত্রের পারফরম্যান্স বিশ্ববাজারে একটি জঙ্গিবিমানের গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড। গত ৭ মের শেষ রাতে মাত্র তিন ঘণ্টার আকাশযুদ্ধে পাকিস্তান বিমানবাহিনী যেভাবে তিনটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে, তাতে ফরাসিদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ওই রাতে আরো ভূপাতিত হয় মিগ-২৯ ও সুখই-৩০ নামে দু’টি রুশ জঙ্গিবিমান। এ ছাড়া পাকিস্তান গত তিন দিনে ইসরাইলের তৈরি ৭৭টি অত্যাধুনিক হরপ ড্রোন ধ্বংস করেছে। গ্রাউন্ড অপারেশনেও পাকিস্তান ভারতের একটি ব্রিগেড সদর দফতর, একটি ব্যাটালিয়ন সদর দফতর ও কয়েকটি সীমান্ত চেকপোস্ট উড়িয়ে দিয়েছে।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, ভারত যখন রাফাল জেট কিনতে ফ্রান্সের সাথে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করছিল, তখন খুব গৌরবের সাথে এটিকে গেম চেঞ্জার হিসেবে অভিহিত করেছিল। ভাবখানা এমন ছিল, এবার পাকিস্তানকে দেখিয়ে দেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ ২০১৯ সালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করার সময়ও পাকিস্তান ভারতের দু’টি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেছিল। প্যারাসুট দিয়ে নামতে সক্ষম হওয়া একজন পাইলটকে আটকও করেছিল। তার নাম ছিল অভিনন্দন।

দিল্লি এ হামলাকে অত্যন্ত সফল হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে অবস্থিত জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান বলেছে, একটি পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র, মসজিদ, মাদরাসাসহ ছয়টি বেসামরিক স্থানে হামলা করা হয়েছে। এতে শহীদ হয়েছে শিশুসহ ৩১ জন। তবে ভারত যদি মনে করে থাকে, পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিক জঙ্গি তাহলে বেসামরিক সব লোকালয় জঙ্গি ক্যাম্প। সেই অর্থে ভারতীয় দাবি সঠিক!

এ দিকে ৭ মের আকাশযুদ্ধে ভারতের বিমানবাহিনীর দুর্বলতা বিশ্ববাসীর কাছে নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। অথচ প্রচলিত যুদ্ধে স্থলবাহিনীর জন্য বিমানবাহিনীর সহায়তা খুব জরুরি। সামরিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আকাশ সহায়তা না থাকলে স্থলবাহিনী শত্রুর সহজ নিশানায় পরিণত হয়। সৈনিকদের নৈতিক বল অনেক কমে যায়। হয়তো সে জন্য ভারতীয় বাহিনীর জেনারেলরা যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। পুরাণের কল্পিত শক্তি বাস্তবে রূপ দিতে একটি পেশাদার সেনাবাহিনীকে অনৈতিক যুদ্ধে নামিয়েছিল ভারত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারত যেভাবে পাকিস্তানে আক্রমণ চালিয়েছে তাকে কোনোভাবে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান হিসেবে গণ্য করা যায় না। এটি সরাসরি আগ্রাসন এবং জাতিসঙ্ঘ সনদের পরিপূর্ণ লঙ্ঘন।

এসব ছাড়াও সামরিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পুরো যুদ্ধক্ষেত্র একটি পারমাণবিক যুদ্ধক্ষেত্র। কারণ ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ পারমাণবিক শক্তিধর। ফলে যেকোনো উত্তেজনা মুহূর্তে পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সুতরাং এটিকে পারমাণবিক ক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে। অথচ পারমাণবিক যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ভারত ও পাকিস্তান কোনো পক্ষের সেনাবাহিনীর নেই, বিশেষ করে আগ্রাসনকারী হিসেবে ভারতীয় বাহিনীর দায় সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারটিও ভারতীয় সেনা নেতৃত্ব বুঝতে সক্ষম। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী উচ্চাভিলাষের কাছে তারা পরাজিত হন। ফলে ভারত পাকিস্তানের সাথে গায়ের জোরে যুদ্ধে জড়ায়। কোনো পেশাদার সেনাবাহিনী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উচ্চাভিলাষচরিতার্থ করতে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার মতো উচ্চ ঝুঁকিতে যেতে চায় না। ভারতীয় সেনা নেতৃত্ব তা অনুধাবন করে এবারের যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে অনীহা জানায়। কিন্তু বিজেপি সরকারের বাগাড়ম্বরে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়। তবে পাকিস্তানের হামলায় বেকায়দায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানায়। মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধবিরতির বিষয়টি সফলভাবে হ্যান্ডেলিং করায় এ যাত্রা ভারতের মুখ রক্ষা হয়েছে।

পাকিস্তানের আক্রমণের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রদত্ত এক বিবৃতিতে এ আক্রমণকে যুদ্ধ বিস্তারের অভিপ্রায় নয় বলে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন ঝিলমের ওপর স্থাপিত হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন শহরে, মসজিদ, মাদরাসা ও বিভিন্ন বেসামরিক স্থানে মিসাইল আঘাত কি ভারতের যুদ্ধ বিস্তারের অভিপ্রায় ছিল না? বরং এটি পাকিস্তানের ওপর নগ্ন হামলা বলে বিবেচিত হয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের যুদ্ধাভিযানের নামকরণ দেখে কেমন যেন ধর্মযুদ্ধের মতো মনে হয়েছিল। প্রথমে ভারত সামরিক অভিযানের নামকরণ ‘অপারেশন সিঁদুর’ করায় বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হয়। মনে হয়েছিল, হাজার বছর আগে খ্রিষ্টানরা জেরুসালেম দখলের অভিপ্রায়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামকরণ করেছিল ক্রুসেড; অর্থাৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে খ্রিষ্টানরা পবিত্র যুদ্ধ হিসেবে ভাবত। আর ক্রুসেড অর্থ পোপ অনুমোদিত পবিত্র যুদ্ধ। ঠিক একইভাবে ভারত এই যুদ্ধের নামকরণ সিঁদুর করায় অনেকে মনে করেন, এটি ক্রুসেডের হিন্দুত্ববাদী সংস্করণ। হিন্দুধর্মে সিঁদুরকে শুভ বা কল্যাণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। হিন্দুধর্ম মতে, স্ত্রী তার শক্তি দিয়ে স্বামীকে যেকোনো বিপদ থেকে বাঁচাতে পারেন। এ থেকে বোঝা যায়, সিঁদুর শুধু শুভ নয়, শক্তিরও প্রতীক। তাই একটি ফুটেজে দেখা যায়, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিঁদুর দিয়ে একটি জঙ্গিবিমানের পূজা করছেন।

এ দিকে পাকিস্তান অভিযানের নাম করে ‘বুনিয়ানুম মারসুস’। এটি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অংশ। সিসাঢালা প্রাচীর। মর্মার্থ দুর্ভেদ্য দুর্গ।

অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবারো ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক য্দ্ধু থেকে সরে আসায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু এর মধ্যে বেশ কিছু নিরপরাধ মানুষের জীবন ঝরে পড়ার দায় কে নেবে? নিশ্চয় এটি যে ভারতের বাড়াবাড়িতে হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।