স্বৈরাচার-উত্তর ষোল মাসে দেশে ন্যায্য-অন্যায্য দাবি নিয়ে হরেক রকমের ব্যানারে মতলবি-অমতলবিরা পাবলিক স্পেসে হাজির হয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত দাবি আদায়ে রাস্তা আটকিয়ে যে কর্মসূচি পালন করছেন, এতে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে তাতে নাগরিক সমাজ বিশেষ করে ঢাকাবাসী বিরক্ত। চলতি বছরের শেষ সময়ে এসে রাস্তায় না নামলেও সারা দেশে কর্মসূচির নামে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকরা এই তালিকায় নাম লেখালেন। গেল সপ্তাহ পার হয়েছে তাদের কর্মবিরতিতে। তবে ইতোমধ্যে মাধ্যমিকের শিক্ষকরা কর্মসূচি স্থগিত করলেও প্রাথমিকের শিক্ষকরা তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখতে এখনো অনড় অবস্থানে আছেন।
সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনে থাকায় সারা দেশে শিক্ষা কাঠামোর সবচেয়ে বড় দু’টি স্তর বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সঙ্কটে। যদিও বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে এমন আন্দোলনে যাওয়া কোনো নৈতিকতার মানদণ্ডে পড়ে না। বাস্তবতা হলো- শিক্ষকদের আন্দোলন অভিভাবকদের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, শিক্ষকতা একটি মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক পেশা। আর দশটা পেশা থেকে এটি আলাদা। শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন করলে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যে কায়দায় দাবি আদায়ে নেমেছেন; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ না করে ছাত্রছাত্রীদের পণবন্দী করে দাবি আদায়ের যে কৌশল নিয়েছেন; তা সমর্থনযোগ্য নয়। শিক্ষক সমাজের এমন আচরণ কাম্য নয়। তবে এটি অস্বীকারেরও উপায় নেই, দেশে শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষকতা অবহেলিত। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষাকে কোনো সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়নি। বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী আমলে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহসা পূরণীয় নয়।
শিক্ষকরা শ্রদ্ধার পাত্র। তারা নিজেদের দাবি জানালে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার সময় কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আশার কথা, এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কর্মবিরতি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। তারা বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষকরা দাবি আদায়ে অনড়। তারা বেতন বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি করেন। গত ২৭ নভেম্বর থেকে কর্মবিরতি শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ। গত সপ্তাহের শুরুতে বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি নেয়। আর বুধবার থেকে কমপ্লিট শাটডাউনে গেছেন। বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সারা দেশে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এমনিতে আমাদের শিক্ষা খাত নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এর ওপর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনে দেশজুড়ে এই দুই স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকদের যেসব দাবি ন্যায্য তা পূরণে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। তেমনি শিক্ষকদেরও আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের পথে হাঁটতে হবে।
স্মরণে রাখা দরকার, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সমাধানের টেকসই পথ। তাই সরকার ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়া জরুরি। আমরা আশা করি, মাধ্যমিক শিক্ষকরা যেমন তাদের কর্মবিরতি স্থগিত করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষকরাও তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করবেন। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের সারা বছরের শিখনের মূল্যায়নে ব্রতী হবেন।



