আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। দিনটি আমাদের আত্মপরিচয় লাভের দিন। তবে এবারের বিজয় দিবস দেশবাসীর জন্য ভিন্ন এক আবেগ-অনুভ‚তি নিয়ে হাজির হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের কবলে পড়ে দীর্ঘ দিন দেশ গণতন্ত্রহীন ছিল। দেশ চব্বিশের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসবে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এবারের বিজয় দিবস জাতীয় জীবনে নিয়ে এসেছে অযুত সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ৫৪তম বিজয় দিবস পূর্তির এ ক্ষণে লাল সূর্য নতুন ‘আলোর ঝরনাধারা’ বয়ে আনবে জাতির জীবনে-এটিই প্রত্যাশা। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলা হয়েছে; তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে এ ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ে আমাদের যেমন কিছু অর্জন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও কম নয়। আর্থসামাজিকভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এখনো অনেক দূরে। বিশেষ করে ধনী-গরিবের ব্যবধান আকাশচুম্বী। স্বাধীনতার সুফল আমরা প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে পেরেছি এমন নয়; বরং মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে যেন সব সুবিধা পুঞ্জীভ‚ত হয়েছে।
আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। চব্বিশের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দেশ আবার গণতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী শাসনে মৌলিক মানবাধিকার শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল। যা ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্যমুক্ত-শোষণমুক্ত স্বদেশ, যে বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমুন্নত। জনগণ পাবে সর্বজনীন মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বাধাহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বাধীনতা। নাগরিকরা পাবেন নিজের অবস্থান উত্তরণের সুযোগ। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তিতে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, সে মূল্যায়ন এখন জরুরি।
পাঁচ দশকের বেশি সময়ে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের কিছু সূচক বৈশ্বিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশবাসীর জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে। গ্রাম-শহরে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু গ্রাম-শহরে জীবনযাত্রার ফারাকও ব্যাপক। স্বৈরশাসনমুক্ত সময়ে এ ব্যবধান ঘোচানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জোরালোভাবে নিতে হবে। স্বৈরাচারের হাত ধরে দুর্নীতি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুশাসনের অনুপস্থিতি এবং দুর্বল গণতন্ত্র ছিল এর জন্য দায়ী। রাজনীতি ও প্রশাসনে গণতন্ত্র চর্চা ফেরাতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে সেই অনুক‚ল পরিবেশ করে দিতে হবে।
আমরা দেখছি, প্রায় একই সময়ে স্বাধীনতা পেয়ে অনেক দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। নির্মাণ করেছে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আমরা সেটা পারিনি। স্বাধীনতাকামী মানুষ যে চেতনা নিয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই চেতনার যথাযথ মূল্যায়নের পথে হাঁটতে হবে আমাদের। এ জন্য দরকার বিভেদের দেয়াল ভেঙে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। জাতীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রীতির পথে আমাদের হাঁটতে হবে।



