বিরোধীদের গুম করে ফেলা হাসিনা শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশানা করা হলেও শেষ পর্যন্ত অরাজনৈতিক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ কেউ বাদ যাননি। এ জন্য একটি বিশেষ বাহিনী তিনি গড়ে তুলেছিলেন। সেই বাহিনী এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রুকে শায়েস্তা করতে, এমনকি টাকার বিনিময়ে গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে। ফলে হাসিনার শাসনে দেশজুড়ে চরম এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল। সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না যতক্ষণ পর্যন্ত গুমের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা না হয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে গুমের বিচারে আশাজাগানিয়া অগ্রগতি দৃশ্যমান করেছে।
শেখ হাসিনা ঠাণ্ডামাথায় বাহিনীগুলো দূষিত করেছেন। প্রত্যেক বাহিনীতে বাছাই করে একটি শ্রেণীকে এ নিষ্ঠুর কাজে জড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা সামরিক বাহিনীর সদস্য তারা বাহিনীতে থেকে এমন পৈশাচিক কর্মের সাথে জড়াননি। সাধারণত র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থায় গিয়ে হাসিনা ও তার সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর আদেশে এ ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। তাদের আবার সামরিক বাহিনীতে ফিরে আসা ভয়ের ব্যাপার। তারা যেকোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। অভিযুক্ত ডিজিএফআইয়ের প্রধানরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছেন। গুম কমিশনে এক হাজার ৮০০ গুমের অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে একটি অংশ সামরিক বাহিনী থেকে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ে আসা সদস্যরা ঘটিয়েছেন।
গুমের সাথে জড়িত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সব সদস্যকে আলাদা করতে হবে। একবার যারা গুম-খুনের সাথে জড়িত হন, তারা সুযোগ পেলে আবারো একই কাজ করবেন না তার নিশ্চয়তা কী। তাই তাদের নিবৃত্ত করা দেশের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনী ও পুলিশের স্বার্থেও এটি জরুরি। ইতোমধ্যে আইসিটির জারি করা সামরিক বাহিনীতে কর্মরতদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সামরিক বাহিনী তামিল করেছে। তাদের ১৩ জনকে সেনা হেফাজতে নিয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
আমাদের সেনাবাহিনীর মোট সদস্যের তুলনায় এ ধরনের অপরাধীদের সংখ্যা খুব নগণ্য। তবে বাহিনীতে তাদের অবস্থান বিপজ্জনক। সামরিক কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তারা গুম ও খুনের মতো মানবতাবিরোধী সব অপরাধের সঠিক বিচার চায়, ইনসাফ চায়। সে জন্য আইসিটির আদেশের প্রতি সাড়া দিয়েছে। সামরিক বাহিনী উপলব্ধি করতে পারছে, অপরাধের সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা না গেলে বাহিনী হিসেবে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। অল্প কয়েকজনের জন্য পুরো বাহিনী কোনোভাবে দুর্নামের ভাগিদার হতে পারে না।
সামরিক-বেসামরিক উভয় প্রশাসনকে গুমের কাজে জঘন্যভাবে ব্যবহার করেছেন হাসিনা। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর বীজ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই রাষ্ট্রকে মানবিক করতে হলে গুমের সমর্থক ও সহানুভূতিশীল পুরো কাঠামোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি দীর্ঘ লড়াই হবে। প্রথমত, গুমের সাথে সরাসরি জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এ কাজে সফল হলে একটি গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে। সে জন্য সরকারকে দৃঢ় ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।