নবীপ্রেম : হৃদয়ের দীপ্তি ও মানবতার দিশারি

নবীপ্রেম আশিকের কাছে শুধু ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক তৃপ্তি নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের এক চেতনা। তাঁর হৃদয়ে সবার জন্য দোয়া থাকে, তাঁর দৃষ্টিতে শত্রুও আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত নয়। এই প্রেম ও করুণার সর্বোচ্চ, সর্বোত্তম ও পরম মোহনার নাম রাহমাতুল্লিল আলামীন। আশিকে রাসূল তাই নবীপ্রেমের আলোতেই গড়তে চান মানবকল্যাণমুখী সমাজ। যে সমাজের শেকড়ের নাম হক বা সত্য, কাণ্ডের নাম ইনসাফ ও ইনসানিয়াত, ডালপালার নাম এহসান বা বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ উত্তমতা এবং পাতা-পল্লবের নাম দয়া, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সমৃদ্ধি

সিরাতে রাসূল সা:-এর মহান শিক্ষা ও আবেদনের কুঁড়ি যে হৃদয়ে জেগেছে, সে হতে থাকে আশেকে রাসূল। নবীজির ইশক ও মহব্বত প্রেমিককে করে দীপ্ত ও তৃপ্ত। এটি তার সম্পদ, তার মূলধন; তার সাফল্যের গোপন সূত্র। এটি তার সাফল্যের প্রকাশ্য হাতিয়ারও। এশকে রাসূল সা: আমাদের সমাজে আবেগ হিসেবে হাজির। কিন্তু অন্তর্নিহিত আবেদন ও এশকের দাবির প্রতিফলন কমই দৃশ্যমান। বস্তুত এশকে রাসূল কোনো প্রভাবহীন অনুভূতিমাত্র নয়, বরং তার দশা ও দিশা জীবনে আনে রূপান্তর। মুমিনচিত্তে ও জীবনে যেভাবে এশকে রাসূল সা: প্রতিফলিত হয়, তার নানা মাত্রা রয়েছে। যেমন-

১. রাসূলে খোদার সা: ভালোবাসা সব কিছুর উপরে : প্রেমিকের কাছে সব সময় নিজের জান, মাল এশকে রাসূল সা:-এর জন্য নিবেদিত। তিনি নিজের পিতা-পুত্র, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন আল্লাহর রাসূল সা:-কে। এমনকি নিজের চেয়েও বেশি।

যেখানে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, বলো, ‘যদি তোমাদের পিতারা, আর তোমাদের সন্তানেরা, আর তোমাদের ভাইয়েরা, আর তোমাদের স্ত্রীরা, আর তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা আর ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় করো, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস (এসব) যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তাহলে অপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফয়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা : ২৪)।

কেন একজন আশিক নিজের সাথে সম্পর্কিত সবকিছুর উপরে প্রাধান্য দেবেন না নবীর ভালোবাসাকে, যেখানে আল্লাহর ঘোষণা, ‘নবী (মুহাম্মদ) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মা। আর আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কীয়রা পরস্পরের অধিক নিকটবর্তী অন্যান্য মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে। তবে তোমরা যদি তাদের প্রতি সদাচরণ করো সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। আর এটাই মূল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে’ (আহজাব : ৬)।

কেন একজন আশিক নিজের পিতা-মাতার চেয়ে প্রিয় নবীকে অধিক মহব্বত করবেন না, যেখানে হাদিসে রয়েছে স্পষ্ট ঘোষণা? আনাস রা: হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় হবো; তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে’ (মুসলিম : ৪৪; বায়হাকি শোআব : ১৩১২)।

কিন্তু মুমিনের কাছে নবীপ্রেম আরো বড় বিষয়। এখানে নিজের সত্তাকেও ভালোবাসা যাবে না নবীর অধিক। ফলে তিনি নিজেকে ভালোবাসেন বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন আল্লাহর রাসূল সা:কে। কেন তিনি এমনটি করবেন না, যেখানে ঈমানের পূর্ণতা ভালোবাসার এই পূর্ণতার উপর নির্ভরশীল?

২. সুন্নাহ হলো নবীপ্রেমের প্রকাশের ভাষা : নবীপ্রেমের দাবি কী? অবশ্যই তাঁর আনীত সব কিছু মেনে নেয়া। সব আদেশ মানা, সব নিষেধ পরিহার করা। এসব ব্যাপারে আশিকের অবস্থান হলো নিঃসঙ্কোচে, বিনা প্রশ্নে ও দ্বিধায় শুনলাম এবং মানলাম। কোনো চিন্তার দরকার নেই, কোনো ভাবনা ও দ্বিতীয় বিবেচনার অবকাশ নেই। নবীর আদেশমাত্রই পরম ভালো, নবীর নিষেধমাত্রই চরম নিষেধাজ্ঞা। কেন এমনটি হবে না, যেখানে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন-

‘মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হবে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর তারাই হবে সফলকাম’ (নূর : ৫১)।

আল্লাহর হাবিবের উপর অধিক হারে দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা সুফিবৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক মুমিনই তা পাঠ করেন। কিন্তু আশিকের কাছে ব্যাপারটা আরো গভীর, আরো ব্যাপক, আরো অর্থবহ। তিনি মহাজাগতিক দরুদ ও সালামের সেই প্রবাহে থাকেন, যার সম্পর্কে আল কুরআনের ঘোষণা-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও যথাযথভাবে সালাম প্রেরণ করো’ (আহজাব : ৫৬)।

আশিক তার সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উচ্চ সম্মানকে প্রকাশ করেন। তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। অন্য সবাইকে সজাগ করেন। এই সজাগ অনুভ‚তি হৃদয়ে হৃদয়ে পুঁতে দেন। কারণ আল্লাহর ঘোষণা, যারা প্রেরিত উম্মী নবীকে অনুসরণ করবে যা তাদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে তারা লিখিত পাবে। সে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎ কাজ করতে নিষেধ করে, পবিত্র বস্তুসমূহ তাদের জন্য হালাল করে, অপবিত্র বস্তুগুলো তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে, তাদের থেকে গুরুভার সরিয়ে দেয় আর সেই শৃঙ্খল (হালাল-হারামের বানোয়াট বিধিনিষেধ) যাতে ছিল তারা বন্দী। কাজেই যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করে, তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করে আর তাঁর উপর অবতীর্ণ আলোর অনুসরণ করে, তারাই হচ্ছে সফলকাম (আরাফ :১ ৫৭)।

৩. আহলে বাইত-সাহাবা ও সালাফে সালেহীনের প্রতি তাজিম ও ভালোবাসা : সাহাবায়ে কেরাম এবং আহলে বাইতকে ভালোবাসা আশিকের রূহের ওজিফা। মুমিনমাত্রই এই ভালোবাসা হৃদয়ে পোষণ করবেন। এই তাজিম লালন করবেন। ঈমানের ব্যাপারে অগ্রগামী পূর্ববর্তী আল্লাহওয়ালাদের প্রতিও আশিকের তাজিম প্রশস্ত। আল্লাহ বলেন, ‘যারা পরে ইসলামের ছায়াতলে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করো, যারা ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রবর্তী। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোনোরূপ হিংসাবিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি অতিশয় করুণাময়, পরম দয়ালু’ (হাশর : ১০)।

যায়েদ বিন আরকাম রা: হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা: একদা আলোচনায় দাঁড়িয়ে বললেন, ... ‘আর আমার পরিবারবর্গের বিষয়ে আমি তোমাদের আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।’ অর্থাৎ রাসূল সা:-এর পরিবারবর্গের যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে হবে।

৪. প:বো কি নবীর দিদার জীবনে! রাসূল সা:-এর সাথে জান্নাতবাসী হওয়ার আশা প্রত্যেক সুফির পরম কামনা। আবার ইহজীবনে রাসূলে খোদা সা:-এর দিদারের তামান্না তাদের ব্যাকুল করে। দিদারের জন্য তাদের বাসনা হয় উদগ্র। সেই সব আশিকের কথা স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা: বলে গেছেন পবিত্র জবানে। হাদিসের ঘোষণা, ‘আমার উম্মতের মধ্যে আমাকে অত্যধিক ভালোবাসবে কিছু মানুষ, যারা আমার বিগত হওয়ার পর আসবে। তাদের মধ্যে কেউ এমন আকাক্সক্ষা পোষণ করবে যে, যদি সে তার পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদের বিনিময়েও আমাকে দেখতে পেতো!’

৪. গোমরাহির বিরুদ্ধে নিরাপস, কল্যাণের জন্য দরদি : যা কিছু ইসলামের পরিপন্থী, যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর কাছে ঘৃণ্য, তা থেকে আশিকে রাসূল সা: যোজন যোজন দূরে। খোদাদ্রোহে খুব কাছের কেউ যুক্ত হলেও তাকে পরিহার করেন তারা। প্রত্যেক মুমিনের এই বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশিত ও নির্দেশিত। কিন্তু প্রেমিকদের মধ্যে তা জীবন্ত ও জ্বলন্ত। আল্লাহর ঘোষণা, ‘যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী তাদের কাউকে তুমি এমন পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতাকারীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। যদিও তারা তাদের পিতৃপুরুষ, সন্তানাদি, ভ্রাতৃমণ্ডলী অথবা নিকটাত্মীয় হয়’ (সূরা মুজাদালাহ : ২২)।

আশিকদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো পাপের প্রতি সর্বোচ্চ ঘৃণা নিয়েও সব মানুষের কল্যাণ কামনা। এতে তাদের উদগ্রীব ও দরদপূর্ণ সত্তা অন্য যে কারো চেয়ে বেশি বিগলিত থাকে। খোদাতায়ালার মারিফাত পাপীদের হেদায়েত কামনা আশিকদের ব্যাকুল করে রাখে। খোদাকে ভুলে যাওয়া মানুষের প্রতি দরদ ও দায়বোধ সুফিচিত্তে প্রবল। ইমাম বুখারি রহ:-এর সনদে দরদ ও দায়বোধের এমন নজিরও আমরা দেখি, যেখানে গোনাহগারের ভালো দিকটা দেখার ইতিবাচকতা শিখিয়েছেন রাসূলে পাক সা:।

নবীযুগে আবদুল্লাহ নামে খুবই আমুদে ও চঞ্চল প্রকৃতির এক ব্যক্তি ছিলেন। লোকেরা তাকে ডাকতেন হিমার নামে। তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-কে হাসাতেন। নবীজির আদালতে মদপানের অপরাধে একবার তাকে বেত্রাঘাত করা হয়। আরেক দিন তাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আনা হলো। রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদেশে আবারো বেত্রাঘাত করা হলো তাকে।

উপস্থিত একজন বললেন, ‘আল্লাহ তার ওপর লানত করুন। কতবার তাকে মাতাল হালতে আনা হলো!

তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তাকে অভিশাপ দিও না। আল্লাহর কসম, তার ব্যাপারে আমি এটিই জানি- সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-কে ভালোবাসে।’

৫. নবীপ্রেমের আলোতে মানবকল্যাণ : আশিকের নবীপ্রেম শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ও মহাজাগতিক। নবী সা: ছিলেন পুরো জগতের জন্য রহমত। তাই প্রেমিক এই রহমতের আলোকে নিজের জীবনকে মানবকল্যাণে নিবেদিত করেন। তাঁর হৃদয়ের দোয়া, দরদ ও দায়বোধে সবাই স্থান পায়। শত্রু নয়, সবাই তাঁর কাছে সম্ভাব্য বন্ধু, সম্ভাব্য হেদায়েতপ্রাপ্ত।

নবী সা:কে ভালোবাসা শুধু হৃদয়ের আবেগ নয়, বরং ঈমানের অংশ। আশিকের নবীপ্রেম কেবল ব্যক্তিগত ভক্তি নয়। বরং তা একটি বিশ্বজনীন নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা মানবকল্যাণে রূপান্তরিত হয়। এই রহমত কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতি, পশুপাখি, পরিবেশ এবং জগতের প্রতিটি সত্তার জন্য। সুফিরা এই রহমতের সাগরে নিমজ্জিত হতে চান, মানুষকে দয়া, শান্তি ও ন্যায়বিচারের পথে আহ্বান করেন। আহ্বান করেন অন্যকে সাহায্য করতে, দরিদ্রের পাশে দাঁড়াতে, মজলুমকে রক্ষা করতে। কারণ রাসূল সা: বলেছেন : মানুষের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য অধিক উপকারী।

ইসলামী দর্শনে নবীপ্রেমকে মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ হিসেবে দেখা হয়। নবীজি হলেন ইনসানে কামিল বা পরিপূর্ণ মানুষের সর্বোচ্চ রূপ। মানবজীবনের চূড়ান্ত নৈতিক, আত্মিক ও জ্ঞানগত আদর্শ তার মধ্যে প্রতিফলিত। সুফির নবীপ্রেম এই আদর্শকে ধারণ করে সমাজে ন্যায়, শান্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা বিস্তার করে, দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে।

নবীপ্রেম আশিকের কাছে শুধু ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক তৃপ্তি নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের এক চেতনা। তাঁর হৃদয়ে সবার জন্য দোয়া থাকে, তাঁর দৃষ্টিতে শত্রুও আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত নয়। এই প্রেম ও করুণার সর্বোচ্চ, সর্বোত্তম ও পরম মোহনার নাম রাহমাতুল্লিল আলামীন। আশিকে রাসূল তাই নবীপ্রেমের আলোতেই গড়তে চান মানবকল্যাণমুখী সমাজ। যে সমাজের শেকড়ের নাম হক বা সত্য, কাণ্ডের নাম ইনসাফ ও ইনসানিয়াত, ডালপালার নাম এহসান বা বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ উত্তমতা এবং পাতা-পল্লবের নাম দয়া, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সমৃদ্ধি।

লেখক : কবি, গবেষক

[email protected]