বিগত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লাখো কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার অসম চুক্তি হয়েছে। এসবের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের হরিলুট হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। নেয়া হয়নি কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগও। সম্প্রতি ঢাকায় এক জ্বালানি সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ খাতে অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে এখন শক্তিশালী সংস্কার বাস্তবায়ন এবং একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মূলত জ্বালানিসংশ্লিষ্ট পরিবেশগত বিষয় নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সেখানে এ খাতে বিদ্যমান কিছু সত্য উঠে এসেছে স্বয়ং জ্বালানি উপদেষ্টার মুখে। জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতি কমিয়ে আনতে গোটা বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগোচ্ছে, তখন আমরা এক্ষেত্রে সবার চেয়ে পিছিয়ে আছি। কেন পিছিয়ে আছি, সেটিই বলেছেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি স¤প্রসারণে প্রধান বাধা হলো খোদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লোকজন। এই খাতের অনেকে ব্যবসায় জড়িত। স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা চালু হলে তারা তাদের লেনদেনের সুবিধা হারাবেন।
উপদেষ্টার এই একটি মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট- কেন আমরা জাতীয় জীবনের প্রতিটি খাতে এভাবে পিছিয়ে পড়ছি। এই প্রবণতা কেবল জ্বালানি খাতে নয়, রাজনীতি-অর্থনীতির প্রতিটি অঙ্গনে দেশবিরোধী কোটারি স্বার্থ বা সিন্ডিকেট জেঁকে বসে আছে। তারাই পুরনো লুটপাটের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।
জ্বালানি সম্মেলনে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি স্থাপনের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশে পুনঃস্থাপন করা হোক- যা সরকার স¤প্রতি কমিয়েছে। উপদেষ্টা বলেছেন, যদি সুযোগ থাকত, আমরা এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কেনা এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতাম। এ বিষয়ে নীতিগতভাবে কারো দ্বিমত নেই। তবে এটি করতে হবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই। বিশ্বের কোনো দেশই নিজেদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সম্মত হয়নি, যাতে তাদের শিল্পের গতি থেমে যায় অথবা শ্লথ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে পরিবেশ নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাদেরও এই আলোকেই ভাবতে হবে। তেল বা কয়লাভিত্তিক শিল্প এক লহমায় বন্ধ করে দেয়ার মতো অবস্থায় আমরা নেই।
বিগত সরকার অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংসের মুখে ফেলে রেখে গেছে, তাতে চাইলেই কারো পক্ষে সব কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি খাতে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের একটি কর্মসূচির সূচনা করতে পারে। যে লাখ লাখ কোটি টাকা তছরুপ ও পাচার করা হয়েছে তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারে।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে বেশি সময় অবশিষ্ট নেই। তবে তারা কাজটি শুরু করে দিয়ে যেতে পারে। নির্বাচিত সরকার পুরনো লেনদেনের সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে উঠে এ বিষয়ে আদৌ মনোযোগ দিতে পারবে কি-না সংশয় আছে।



