রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান, অনৈক্য দূরে সহনশীলতা কাম্য

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য জাতি প্রত্যাশা করে না।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটলে দেশবাসী আশায় বুক বেঁধেছিলেন; তারা ভবিষ্যতে সুন্দর একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাবেন। যেটি গড়তে শেখ হাসিনা জমানায় নিগৃহীত রাজনৈতিক দলগুলো নিষ্ঠার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো পরস্পরকে ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একে-অপরের প্রতি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তি গড়ে তুলবে।

গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর কিছু সময় এ লক্ষণ বেশ জোরালো ছিল; কিন্তু ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আলাপ শুরুর সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাস যেন বাড়ছে। অথচ এসব দল বেমালুম ভুলে গেছে, রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এখনো দেশের ভেতরে যেমন অপতৎপরতার জন্য ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, ঠিক তেমনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত। খোদ পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোস্যাল মিডিয়ায় নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বৈরী প্রতিবেশী ভারত মদদ দিচ্ছে।

সবার জানা, দিল্লির তাঁবেদার শেখ হাসিনা সরকারের পতন কোনোভাবে মেনে নেয়নি ভারত। ফলে প্রতিনিয়ত দিল্লি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সবধরনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্যপট স্পষ্ট থাকার পরও স্রেফ দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু দাবিদাওয়া উত্থাপন করছে।

উপরোক্ত কথাগুলো অবতারণা করার কারণ হলো- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সাম্প্রতিক বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিন দলই আলাদা আলাদাভাবে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কেউ কেউ আবার অপসারণের দাবিও তুলেছেন। এ তিন দলের অভিযোগের ধরন এবং অবস্থান বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয়, তারা শুধু সরকারের ওপর নয়, পরস্পরের বিরুদ্ধেও চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক প্রভাবের প্রশ্নে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা এখানে দৃশ্যমান।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করে তিন দলই কিছু বিষয়ে নিজেদের বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি, গণভোটের সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো এখনো একমত হতে পারেনি। দলগুলোর এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে নতুন কোনো সঙ্কট তৈরি হয় কি না, সেই আশঙ্কা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা রয়েছে। তাই এটি সহজে অনুমেয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখনো ঠিক না হওয়ায় দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরতে নারাজ।

একটি সহযোগী দৈনিককে সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘সরকার এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় আছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশগুলো দেবে, সেগুলো নিয়ে আমরা বসব। উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য জাতি প্রত্যাশা করে না। সঙ্গত কারণে সবার মতো আমাদেরও চাওয়া, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার অন্তরালে পরস্পরের সাথে বসে জাতীয় স্বার্থে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ও অনৈক্য দূর করতে সহনশীলতার পরিচয় দেবে।