গরমে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, আর্থিক ক্ষতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই

রাষ্ট্র পরিচালকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পরিস্থিতি সামলানোর কোনো পথ সত্যিই নেই। আর এই গবেষণার তথ্য জানার পর গরমের প্রভাব যদি মানসিক রোগে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে জাতীয় বিপর্যয়।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা নানা কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়াসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশে বেশ কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তাপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে। অতিরিক্ত গরমে বিশেষ করে সাধারণ কর্মজীবী মানুষ পুরোমাত্রায় কাজ করতে পারছে না। ফলে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হচ্ছে, কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে বিপুল। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জানা গেল।

গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গরমের অনুভূতি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি। এ সময় রাজধানী ঢাকার গরম বেড়েছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীর গরম জাতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। এই ভয়ানক তাপ বৃদ্ধির কারণ বø্যাক কার্বন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো কয়েকটি ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ। অনেক গবেষকের মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ন ও দূষণ। কল-কারখানা, মোটরযান, ইটভাটা ইত্যাদি মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার উত্তাপ মাত্রা ছাড়িয়েছে। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর ঝুঁকি বাড়ছে। নানা ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, গরমের প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে আছে। গরমের কারণে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। এতে দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা।

পরিমাণটা বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এ জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে কী করণীয় তা সবারই জানা। সহজভাবে বললে, যেসব কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যায় সেগুলো দূর করতে হবে। কথাটি বলা সহজ, বাস্তবে রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব।

যেমন- বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, ১৯৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মাত্র তিন দশকে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ গড়ে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। তবে নগরীর যেসব এলাকায় জলাভূমি আছে, সেখানে তাপ বৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম। এই তিন দশকে ঢাকার জলাভূমি কমেছে ৬৯ শতাংশ। জলাভূমি হ্রাসের এই হার চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ জলাভূমি নিঃশেষ হবে। নগরের তাপমাত্রা আরো বাড়বে।

এই আত্মধ্বংসী প্রবণতা রোধের উপায় কী? জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নগর সম্প্রসারণ রোধ করা যাবে না। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে নগরায়ন হলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা সীমিত করা সম্ভব। সেটিও আমাদের সাধ্যের বাইরে বলেই মনে হয়। গত ৪০ বছরে আমরা ঢাকা মহানগরীর জন্য একটি ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এই একটি উদাহরণই আমাদের ব্যর্থতা বোঝার জন্য যথেষ্ট।

রাষ্ট্র পরিচালকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পরিস্থিতি সামলানোর কোনো পথ সত্যিই নেই। আর এই গবেষণার তথ্য জানার পর গরমের প্রভাব যদি মানসিক রোগে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে জাতীয় বিপর্যয়।