সংস্কারে সুসংহত হবে দেশ

চব্বিশের বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে থেকে যে অভিনন্দন এবং গ্রহণযোগতা পেয়েছে, তা যে শুধু একটি নৃশংস একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছে, তা কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়, আংশিক। কেননা এশিয়া আফ্রিকা ল্যাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এমন নারকীয় স্বৈরতন্ত্রের মধ্য দিয়ে বিগত শতাব্দী এবং বর্তমান শতাব্দীর ২৪টি বছর কেটেছে। স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নেয়া, দুঃশাসন এবং তার অবসান তাই বিশ্বকে ততটা আন্দোলিত করে না। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-সিপাহি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চব্বিশে যে পটপরিবর্তন ঘটিয়েছে, তার বিশ্বব্যাপী অভিনন্দন এবং গ্রহণযোগ্যতার মূল সত্যটি হলো- নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটি ড. ইউনূসের প্রতি তাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে তার নেতৃত্বের প্রভাব! সত্য বলতে কী বাংলাদেশকে তিনি বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন সদস্য নানা কারণে সমালোচনার মুখে। কারণ বিপ্লবের জোয়ারে তড়িঘড়ি করে তিনি তার টিম গঠন করেছেন। এদের অনেকের সাথে তার পূর্ব পরিচয়ও ছিল না। বিপ্লবের সময় তিনি ছিলেন প্রবাসে। তাকে অনুরোধ করেন তরুণ ছাত্র সমন্বয়কারীরা। সবাই দেশের স্বার্থে জাতির দুর্যোগময় সময়ে রাষ্ট্রের হাল ধরতে সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে তাকে সম্মত করেন।

একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, অনেক সময় ছোটরা বড়দের চেয়ে অনেক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে বলব, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে দেশের বিপদের দিনে হাল ধরার যে ঐতিহাসিক ও সুদূর-প্রসারী ভাবনা যে তরুণদের মাথায় এসেছিল, এ জন্য তাদের আবার আন্তরিক অভিনন্দন। এরা আমাদের অনেকের ছেলে, অনেকের নাতি-নাতনীর বয়সী। গত ৫৪ বছরে ভারতের যে আগ্রাসনের থাবা এবং এ দেশে ভারতের লেজুড়, সেবাদাস ও বেহায়া অনুগত চক্র তাদের হাতে নীরবে নিগৃহীত হয়েছি আমরা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ ঘটানোর কথা তো প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে খুনি হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে প্রতিবাদের সব পথ তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গুম-খুন, মিথ্যা মামলা, দখলবাজি দৌরাত্ম্য এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মজলুমের ফরিয়াদ আল্লাহর আরশ স্পর্শ করেছিল মনে হয়। পরিণতিতে তরুণ-কিশোর দুই হাজার তাজা প্রাণহানি ও ২০ হাজারের বেশি তরুণের আহত ও পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে আল্লাহ গাফুরুর রহিম সেই জুলুমবাজ খুনিদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছেন।

বলে রাখা দরকার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর কেউ কেউ জুলাই-আগস্টের মহাজাগরণের মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করতে পারেননি। সেই সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী দু-একটি রাজনৈতক দল এখন তো প্রকাশ্যে জুলাই বিপ্লবের মর্মবাণী পাশকাটিয়ে ভারত ও তাদের রোপিত বিষবৃক্ষ আওয়ামী লীগকে নিয়ে তথাকথিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার কথা যেভাবে বলছে তাতে সত্যি বিস্ময় জাগে। তাতে এটি প্রতীয়মান হয় যে ওই সব রাজনৈতিক দল দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি তালাশে ব্যস্ত।

অর্থাৎ পরিহাসের ব্যাপার হলো এই যে, ছাত্র-জনতার গণজাগরণের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হলো এরা। পৃথিবীর কত দেশ যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছেন তার হিসাব নেই। তাকে বিশ্বের কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে সম্মানসূচক পদ-পদবি-পদক-সম্মাননা দিয়েছে, যে তালিকা সংরক্ষণে একজন একাডেমিক সহকারী দরকার। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা তার মতো এক প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে পেয়েছি। তার বিশ্ববরেণ্য হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে একচেটিয়া পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রকে মানবিকীকরণ করার চেষ্টা।

১৯৪৫ সালের পর ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যখন বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন অনুভব করতে থাকে তার এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবাট ম্যাকনামারার চোখ পড়ে ড. ইউনূসের জামানতহীন ক্ষুদ্রঋণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রচেষ্টার দিকে। সেই থেকে শুরু ড. ইউনূসের বৈশ্বিক সম্মানের হিমালয়তুল্য উত্থানপর্ব।

এমন বিশ্বনেতা আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, এটা আমাদের জন্য সত্যি সৌভাগ্যের একটি বিষয়। এখন যারা ভারতে বা বাংলাদেশে কিংবা দেশের বাইরে ভারতীয় আশ্রয় প্রশ্নয়ে লালিত পালিত হচ্ছেন তারা ড. ইউনূসকে সমর্থন দেবেন না, এটা গণিতের বাস্তবতা। ড. ইউনূস থাকলে অর্থ পাচার হবে না, গুম-খুন-বাক-ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের বাধা উঠে যাবে, আদালত স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারবেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকের উন্নতি ঘটবে। সেই সাথে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আশু সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হবে। এতে করে সংবিধানের খোল নলচে বদলে যাবে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অবস্থান সংহত হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক