দেশের অর্থনীতি এখনো কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি। পতিত সরকারের হাতে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি অচল অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত এক বছরে তারা অর্থনীতির ধস রোধ করতে পেরেছেন। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের নিম্নমুখী গতি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন আর বড় ধস নামার ঝুঁকি তেমন একটা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক পর্যায় থেকে বেড়ে মোটামুটি স্বস্তিকর পর্যায়ে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। তবে তথাকথিত উন্নয়নের নামে লুটপাটের উদ্দেশ্যে আওয়ামী সরকারের নেয়া বিপুল বৈদেশিক ঋণের বোঝা অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ হিসেবে রয়ে গেছে। গত অর্থবছরে বিদেশী দেনা পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি, যা অর্থনীতিতে নতুন চাপ তৈরি করেছে।
চাপ থেকে গেছে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ার ফলে সৃষ্ট শূন্যতারও। উচ্চ মূল্যস্ফীতির দুর্বিষহ চাপ কিছুটা শিথিল হলেও তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমেনি। মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের বেশি। ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ভোগান্তি খুব একটা কমেনি। রফতানি খাতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক। ২০ শতাংশ হারে বাড়তি শুল্ক রফতানিকারকদের জন্য বিশাল বোঝা। তবে আরো অনেক দেশের ওপর একই ধরনের বা বেশি শুল্ক আরোপ হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকরা কিছুটা স্বস্তিকর পরিবেশ পাবেন। এ দিকে গত ১৫ বছরে বিপুলসংখ্যক তরুণ নতুন করে শ্রমবাজারে যোগ হয়েছেন। বিগত সময়ে চাকরি হারানো ব্যক্তিরাও রয়ে গেছেন বেকারের তালিকায়। ফলে সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার বাড়তির দিকে। অন্য দিকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার করতে গিয়ে সরকারকে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কার ও আসন্ন নির্বাচন ঘিরে একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির একটি সুস্পষ্ট নীলনকশা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে একটি মহল। পতিত স্বৈরাচারের দোসর, সুবিধাভোগী ও মদদদাতাদের এই ষড়যন্ত্র দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগে গতি আসছে না।
এসব কারণে অন্তর্বর্তী সরকার এখন নানা প্রকল্প ও দৈনন্দিন চাহিদা পূরণেও উচ্চসুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাংক খাত সংস্কারসহ সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্চসুদে ১৮৬ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা) ঋণ নিচ্ছে সরকার। পতিত সরকারের সময় ব্যাংকের অর্থ লুটপাট, ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাত ভেঙে পড়ে। ভঙ্গুর ব্যাংক খাতের সংস্কারের কাজে এই উচ্চসুদের ঋণ কাজে লাগানো হবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে গতি ফেরানো সম্ভব না হলে এসব উচ্চসুদের ঋণও বাড়তি বোঝা হয়ে জনগণের ঘাড়ে চাপবে। দেশের সার্বভৌমত্বও নতুন করে হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই এই মুহূর্তে সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমঝোতা ও সমন্বয়ের পথে এগোনোর বিকল্প সত্যিই নেই।



