বন্দর নগরী চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত দীর্ঘদিন থেকেই ছিল। এই অপরাধী-চক্রের হাতে সেখানে খুনাখুনিও হয়েছে। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয়দানকারীরা পালিয়ে গেলে তাদের উৎপাত কিছুটা কমে যায়। কিন্তু এখন আবার তারা নতুন করে প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে।
একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় চলছে বিপথগামী কিশোরদের বেপরোয়া তাণ্ডব। কথায় কথায় মারামারি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ডাকাতি, দস্যুতা, অপহরণ, খুন-ধর্ষণসহ হরেক সব ভয়ঙ্কর অপরাধে আসছে কিশোরদের নাম। বড় ভাই বদল করে ফের ভয়াবহ রূপে ফিরেছে কিশোর গ্যাং। স্কুল-কলেজ এলাকা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা, খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা- সর্বত্রই তাদের দৌরাত্ম্য। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বা নতুন ভবন তৈরির কাজে ভবনমালিক কিংবা ঠিকাদারের কাছে তারা মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে।
পুলিশের এক পরিসংখ্যান বলছে, নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য দুই শতাধিক। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত। তাদের প্রশ্রয়দাতা ৬৪ বড় ভাই থাকার কথা সেই জরিপে উঠে আসে। চট্টগ্রামের স্কুলগুলোয় অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিশোর গ্যাং এক বড় সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার মূলে রয়েছে এখানকার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও ভৌগোলিক অবস্থা। দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নদীভাঙনসহ নানা কারণে শহরমুখী পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এসব পরিবারের কিশোররা গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে উঠছে। এ ছাড়াও দেশের বাস্তুচ্যুত ও পরিবারহারা কিশোরদের মধ্য থেকেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য তৈরি হচ্ছে।
কিশোর গ্যাং সমস্যার সমাধানে এখানকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অপসংস্কৃতি বন্ধ না করে তারা নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে কিশোর গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করছে। চট্টগ্রামে পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এই কিশোরদের ব্যবহার করত। ৫ আগস্ট তাদের পতনের পর নতুন করে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা রাজনৈতিক শক্তি এখন তাদের ব্যবহার করছে।
সমাজের বিদ্যমান কাঠামোতে কিশোর গ্যাং তৈরির নানা উপাদান থাকলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিবারণ করার কোনো পদক্ষেপ নেই। রাষ্ট্র কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধের জন্য আইনের হাতে তুলে দিয়েই যেন তার দায়িত্ব শেষ করে। গ্যাংয়ের সদস্য উৎপাদনের উৎসগুলো যেমন বন্ধ করতে হবে, সেই সাথে এর নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিকদের এই কিশোরদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। কিশোরদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে সামাজিক শক্তিকে যুক্ত করতে হবে।
চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি এই গ্যাংকে সেখানে প্রশ্রয়দানকারী শক্তিরও বিনাশ করতে হবে। কিশোর গ্যাং বন্ধে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের শান্তিকামী মানুষের প্রচেষ্টাও জোরদার করা দরকার।



