আবারো খেলাপি ঋণ নবায়নের সুবিধা, পুরনো পথেই হাঁটছে সরকার

স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর দেশবাসী আশাবাদী হয়েছিল, দেশে বৈষম্যের অবসান ঘটবে, সুশাসন আসবে, জনস্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারে আরো ক’জন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ যুক্ত হওয়ায় মানুষ আশা করেছিল, তারা অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবেন এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতি কোমর সোজা করে দাঁড়াবে। তেমন কোনো লক্ষণ এখনো স্পষ্ট হয়নি। এমনকি তারা মূল্যস্ফীতিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারেননি। চব্বিশের গণহত্যার বিচারে স্থবিরতা জনমনে বিরূপতা সৃষ্টি করছে। বহু ক্ষেত্রে দুর্নীতি অবাধে চলছে। প্রভাবশালীদের তোষণনীতিও অব্যাহত। এরই সর্বশেষ প্রমাণ, খেলাপি ঋণ সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত।

স্বৈরাচারের ১৫ বছরে ঋণখেলাপিদের বারবার সামান্য অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার বা নবায়নের সুযোগ দেয়া হতো। জনমনে ধারণা ছিল, আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে দলীয় নেতাকর্মী, সুবিধাভোগী ও অলিগার্কদের লুটপাটের সুযোগ দিচ্ছে। এর সুফলও তারা পেয়েছে। সুবিধাপ্রাপ্তরা সবসময় সরকারকে সমর্থন দিয়েছে; কিন্তু সেই একই সুবিধা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছে, ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পাবেন। এই সুবিধা যে দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না- তা স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস বলেছে, এই সুবিধা ‘ক্রেডিট নেগেটিভ’ অর্থাৎ ব্যাংক খাতের জন্য ‘নেতিবাচক’।

মুডিসের বিশ্লেষণ হলো- এই সুবিধার ফলে ঋণগ্রহীতার প্রকৃত পরিশোধের ক্ষমতা যাচাই বিলম্বিত হবে, খেলাপি ঋণের হার কৃত্রিমভাবে কম মনে হতে পারে, সম্পদমানের ঝুঁকিও আড়াল হতে পারে। মুডিস মনে করে, এই শিথিল নীতির কারণে প্রকৃত অর্থে ঋণ পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে অনাদায়ী ঋণের ‘চিরায়ত সমস্যা’ দীর্ঘায়িত হবে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, ঋণ পুনঃতফসিল প্রক্রিয়ার যথাযথ তদারকি না হলে দুর্বল ঋণ বাস্তবে নয়, শুধু কাগজে-কলমে সচল দেখানো হতে পারে। এতে বাস্তবে ঝুঁকি থেকে যাবে।

দেশে চলতি বছরের জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোনো কোনো হিসাবে সাত লাখ কোটি টাকা বলেও উল্লেখ করা হয়। এই পুরো টাকাটাই জনগণের কষ্টের টাকা। এর পুনরুদ্ধার এবং মানুষের কল্যাণে বিনিয়োগ করা সরকারের দায়িত্ব; কিন্তু এর বিপরীতটাই ঘটছে বলে মনে হয়। দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার জনস্বার্থের তথা জনগণের আকাক্সক্ষার বিপরীতে হাঁটছে এবং পতিত স্বৈরাচারের অনুসরণ করছে।

খেলাপি ঋণ এখন সরকারের মানসিকতা বোঝার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। সরকার খেলাপিদের সুবিধা দিচ্ছে, নাকি তাদের ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করে জনগণের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে- সেটি দেখেই সরকারের কাজের মূল্যায়ন সম্ভব।

আমরা এ বিষয়ে শুধু বলতে চাই, লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে আর যা-ই হোক, দেশের কল্যাণ হতে পারে না।