বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম, মাথাপিছু মাত্র এক হাজার ৭০ টাকা। সরকারি ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম। এতে করে দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পান না। ৭৩ শতাংশ চিকিৎসা খরচ রোগীকে বহন করতে হয়। স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আছেন মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। প্রায় ৮০ শতাংশ হাসপাতালে উন্নত ডায়াগনস্টিক যন্ত্রপাতি নেই। বেসরকারি খাত ৬০ শতাংশ সেবা দিলেও তা যথেষ্ট উচ্চমূল্য এবং মানের পার্থক্য রয়েছে।
বাস্তবতা হলো- সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এখনো মানুষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী নয়। অথচ স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, যার অর্থ হলো- প্রত্যেক ব্যক্তির রোগমুক্তি বা সুস্থতার সর্বোচ্চ মান অর্জন, যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা বোঝায়।
জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিক যেন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এর মধ্যে রয়েছে উপযুক্ত চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানার অধিকার এবং সুস্থ জীবনযাপনের পরিবেশ পাওয়ার অধিকার, যা আর্থিক সামর্থ্য নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য।
এমন বাস্তবতায় দেশে বিপুল জনগোষ্ঠী আর্থিক কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা আস্থাহীনতায় দেশে চিকিৎসাসেবা না নিয়ে বিদেশে বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। ফলে চিকিৎসা ব্যয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বিদেশে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার মূল কারণ- দেশে চিকিৎসকের আন্তরিকতার অভাব ও সময় কম দেয়া, রোগ নির্ণয়ে উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার অভাব এবং সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থার সঙ্কট ও ভোগান্তি। এর বাইরে উন্নত দেশগুলোতে কিছু রোগের চিকিৎসা ব্যয় কম হওয়া, দ্রুত, নির্ভুল ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং আন্তরিক ব্যবহার পাওয়ার কারণেও রোগীরা বিদেশে যেতে আগ্রহী হন, যা দেশে প্রায়ই মেলে না।
চিকিৎসা নিতে সবচেয়ে বেশি রোগী যান ভারতে। ভারতের চিকিৎসা ভিসার প্রায় ৫২ শতাংশ বাংলাদেশীদের। ২০২৪ সালে প্রায় চার লাখ ৮২ হাজার বাংলাদেশী রোগী দেশটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর পরেই আছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার অবস্থান।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজার ১৪ বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০৩০-৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজার ২৩ বিলিয়ন ডলার হবে, অর্থাৎ- এ খাতের আকার প্রায় দ্বিগুণ হবে। দেশে একই সময়ে মেডিক্যাল ডিভাইসের বাজারও দ্রুত বাড়বে। ২০২৫ সালে এটি ৮২০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা ২০২০ সালে ছিল ৪৪২ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে।
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি বেসরকারি খাতেও উন্নত চিকিৎসায় বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। চিকিৎসায় উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। সেই সাথে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পেশাদারী মনোভাব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই; যাতে রোগীরা তাদের প্রতি আস্থাশীল হন। এতে করে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা কমবে এবং বিপুল কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।



