জুলাই সনদ অবশেষে চূড়ান্ত, এটি সব পক্ষের সাফল্য

দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব দলের ঐক্য সুস্পষ্ট হলে বৈরী শক্তি অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ পেত না। এ বিষয়ে দলগুলো সচেতন থাকবে- এটিই কাম্য।

দীর্ঘ সময় ধরে নানা টানাপড়েনের পর জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। সনদের চূড়ান্ত কপি স্বাক্ষরের জন্য ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্র, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মৌলিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে সনদে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় সম্প্রীতি’র মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকছে। মূল প্রস্তাবের মধ্যে অন্য বিষয়গুলোর সাথে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের এবং উচ্চকক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান বিলুপ্তি বা স্থগিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবনাসহ কিছু অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধকতাও থাকবে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এই সনদ প্রণয়ন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের এক বিরাট সাফল্য। জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অনেকের মতে, এটি হলো স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ঐকমত্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলিল। এর মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র নতুন করে সংজ্ঞায়িত হতে যাচ্ছে দলীয় ক্ষমতার বাইরে এক জনগণনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকনির্দেশনা হিসেবে।

আগামীকাল শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে।

জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করায় সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। জুলাই অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। সই করা রাজনৈতিক দলগুলো সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলবে না।

সনদের পটভূমিতে বলা হয়েছে- ‘জনগণের সম্মিলিত শক্তি এবং প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’

সনদটি সর্বসম্মত হলে ভালো হতো। তবে বিএনপির আপত্তিতে এতে ভিন্নমতের বিষয়টি উল্লেখ থাকছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি সংস্কারের সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। সংস্কার প্রশ্নে দলগুলোর অবস্থান এতে স্পষ্ট হয়েছে, যা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে।

এই সনদ হতে যাচ্ছে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র পর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘গণতান্ত্রিক চুক্তি’ যা একটি নতুন সামাজিক সাংবিধানিক ধারা নির্মাণের ভিত্তি হবে। এর মাধ্যমে যে সাংবিধানিক পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হলো- তাতে ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী ন্যায়ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্রগঠন বাস্তব রূপ পাবে। ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর এই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে তোলা হবে।

ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দোসররা দেশে এবং দেশের বাইরে এখনো সক্রিয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যক্রম ঘিরে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পেরেছে গত এক বছরে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য প্রকাশ হওয়ার কারণে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব দলের ঐক্য সুস্পষ্ট হলে বৈরী শক্তি অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ পেত না। এ বিষয়ে দলগুলো সচেতন থাকবে- এটিই কাম্য।