রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চল সবসময়ই খরাপ্রবণ। এখানে বৃষ্টির পরিমাণ খুব কম এবং তাপমাত্রা বেশি। মাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে সহজে ঢুকতে পারে না। ফলে ভূ-গর্ভের পানির পুনঃভরণ হয় না। সঙ্কট মোকাবেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) মাধ্যমে গভীর নলকূপ স্থাপন করে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কৃষকদের কৃষিকাজের জন্য সেচের পানির ব্যবস্থা করা হয়। সংস্থাটি প্রায় ১৮ হাজার গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভের পানি তুলে কৃষকদের সরবরাহ করছে। ব্যক্তিগত মালিকানায় আছে আরো কয়েক হাজার। বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়ায় সেচের কারণে এখন ভূ-গর্ভের পানি নিঃশেষিত।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্প্রতি সরকার নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় খাবার পানি ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজনে ভূ-গর্ভের পানি তোলা যাবে না। সরকারি নির্দেশনায় ভূ-গর্ভের পানি ব্যবহার করে কোনো শিল্প স্থাপন, জলাধারের শ্রেণিপরিবর্তন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জলাশয়গুলো জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখা বাধ্যতামূলক করেছে। এ ছাড়া জনগণের ব্যবহারযোগ্য খাস জলাশয় ও জলমহাল ইজারা দেয়া নিরুৎসাহিত করতে বলা হয়েছে।
পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত করা, জলাধারের সমগ্র পানি আহরণ করে নিঃশেষ করা, ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে- এমন সব কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর বাইরে বেশি সেচনির্ভর ফসল উৎপাদন নিরুৎসাহিত বা সীমিত করা এবং স্বল্প পানিতে চাষযোগ্য ফসলের আবাদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এসব নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ মেনে চলা বাধ্যতামূলক। ভঙ্গ করলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
সরকারি নির্দেশনায় বরেন্দ্রভূমির অতি উচ্চ পানি সঙ্কটাপন্ন চার লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকায় নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। কৃষিকাজে গভীর নলকূপ বন্ধ করতে হবে কি না, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। করণীয় বুঝতে পারছে না বিএমডিএ। দুশ্চিন্তায় কৃষক, ব্যবসায়ী ও সেচসংশ্লিষ্টরা। কৃষকরা বলছেন, সেচের পানি তুলতে না পারলে তারা ফসল ফলাতে পারবেন না। কিন্তু কৃষিকাজ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব নয়। কৃষি ছাড়াও শিল্পে পিছিয়ে থাকা এই এলাকায় নতুন শিল্প স্থাপনও বন্ধ হয়ে যাবে। সবমিলিয়ে এ এক অশনি সঙ্কেত।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ও শিল্পের জন্য পরিস্থিতি যতই বিরূপ হোক, এটিই চরম বাস্তবতা। আর বাস্তবতা মেনে নিয়েই এর মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে।
এই সমস্যা নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে- এমন সবাই কয়েকটি অভিন্ন মত দিয়েছেন। যেমন ভূতলের (সারফেস ওয়াটার) পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও জলাধারের পানি সেচের জন্য উন্মুক্ত রাখা। পাশাপাশি পানি কম লাগে বা বৃষ্টির পানিতেই চাষাবাদ সম্ভব, এমন ফসল চাষের সুপারিশ করেন তিনি।
প্রায় একই কথা বলেছেন একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া কৃষক মনিরুজ্জামান মনির। তিনিও বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূতলের পানির আধার তৈরি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচকাজে ব্যবহারের পক্ষে মত দেন।
এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় এলাকার অভিজ্ঞতা সামনে রাখা যেতে পারে। সেখানে লবণসহিষ্ণু ফসলের চাষাবাদ করা হচ্ছে। একইভাবে বরেন্দ্র এলাকায় স্বল্প পানিতে চাষযোগ্য কিংবা বৃষ্টির পানিনির্ভর ফসলের প্রচলন শুরুর বিকল্প নেই। এ দিক থেকে সরকারি নির্দেশনা যথাযথই।



