বাংলাদেশের রাজনৈতিক গোলযোগে বিপর্যস্ত হয়েছে গত দেড় দশক। নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠা এক সমঝোতার আলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করায় সেই সমঝোতা ভেঙে পড়ে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মন্দ উদ্দেশ্যে তা করা হয়। ভোটাধিকার হরণের সূত্র ধরে একে একে সব গণতান্ত্রিক অধিকার হারায় মানুষ। উচ্চ আদালতের আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার ফিরে আসছে। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তা দূর হবে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথ উন্মুক্ত রাখবে।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারপতির একটি বেঞ্চ এক আদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এর ফলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে এ সরকার গঠিত হবে। এর বিধান আগামীতে গঠিত হওয়া সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে কার্যকর হবে। বিএনপির সময়ে মাগুরা নির্বাচনে অনিয়মের কারণে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সূত্রে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করে ১৯৯৬ সালে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আয়োজিত তিনটি সফল নির্বাচন হয়। ২০০৮ সালে আয়োজিত চতুর্থ নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প কিছু রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তাব করেনি।
শেখ হাসিনা অনুগতদের দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কলমের এক খোঁচায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। এ কাজে তিনি বন্দুকটি রাখেন বিচার বিভাগের ওপর। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী এনে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দিয়ে নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেন। সে কারণে খায়রুল হক জাতির কাছে নিন্দিত হিসেবে চিত্রিত হন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করে বিচার বিভাগের সম্মিলিত দায়টি পরিশোধ করলেন।
জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিস্তারিত রূপরেখা দেয়া আছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে বাছাইয়ের যে ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়েছে তা মেনে চললে বিতর্ক এড়ানো যাবে। সরকার পরিবর্তনের অন্তর্বর্তী সময় নিরপেক্ষ ও মসৃণভাবে পার হবে। তবে বিষয়টি এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে গণভোটের ফল ও আগত রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার ওপর। বর্ষা বিপ্লব যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তা ভণ্ডুল হতে পারে সঙ্কীর্ণ দলীয় মনোবৃত্তির কারণে। লক্ষ্য যদি থাকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ গণতন্ত্র, তাহলে আমরা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।



