জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-৩০) ব্রাজিলের বেলেম শহরে গত শনিবার শেষ হলো। এবারের সম্মেলনেও আশাবাদী হওয়ার মতো ফল পাওয়া গেল না। বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে একমত হতে পারেননি। অথচ এটিই ছিল সম্মেলনের মূল ফোকাস। পরিবর্তে নেতারা যে বিষয়ে চুক্তিতে পৌঁছেছেন তা হলো- বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব মোকাবেলায় গরিব দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেয়া।
কপ-৩০-এর আলোচ্যসূচির মুখ্য বিষয় ছিল ২০১৫ সালে সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নে কেন্দ্রীভূত। ওই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব উষ্ণতা সীমিত রাখা, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন সহায়তা নিশ্চিত করা।
সম্মেলনে মূল বিতর্ক হয়েছে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানো এবং একপর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ করা নিয়ে। এ কার্যক্রম বিশ্বের সব দেশের ওপর বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৪টি দেশের নেতারা ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির অধীনে একত্রিত হয়ে বিশ্ব উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হলেও প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, তেল উৎপাদনকারী সৌদি আরব, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এ প্রস্তাব বাধ্যতামূলক না রেখে ‘স্বেচ্ছামূলক’ করার পক্ষে অবস্থান নেয়।
শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালীদের চাপে ঠিক তাই হয়েছে। চূড়ান্ত খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা যায়নি। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ না থাকলেও দেশটির শিখণ্ডীরা ছিল। ফলে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। অবশ্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিজেদের জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রগতি অব্যাহত, তবে প্রতিটি দেশের বাস্তব প্রয়াস আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করবে।’ ফলে কার্যত বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমিত রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। কারণ কোনো দেশ প্রয়োজনীয় পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এমন পর্যায়ে সীমিত করবে না, যাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত থাকে। প্রতিটি দেশ শিল্পোৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক লাভ পেতে গুরুত্ব দেবে।
কপ-৩০ থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, বিশ্বের কোটি কোটি হেক্টর বন ও ভূমি সংরক্ষণ এবং ৪০ কোটির বেশি মানুষের সহনশীলতা বৃদ্ধির পদক্ষেপের আভাস পাওয়া গেছে। তবে এ পদক্ষেপগুলো কার্যকর হবে ২০২৬ সাল থেকে। এ বছর ১২০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক তহবিল কার্যকর হবে। তহবিল থেকে অনেক দেশকে জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সীমিত সহায়তা দেয়া হবে। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যেখানে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, চরম বন্যা ও কৃষিক্ষতির ঝুঁকি ক্রমবর্ধমান, সেখানে পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক এই সহযোগিতা এবং অর্থায়ন বিশেষভাবে উপকারী ও কার্যকর হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আভাস দিয়েছে, আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে নদীভাঙন, ভারী বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোজনের অর্থায়ন বাড়ানো, বন ও ভূমি পুনরুদ্ধার এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বিশেষভাবে কৃষি, মৎস্যসম্পদ, পানি ব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনায় বড় ধরনের প্রভাব রাখবে। তবে এ বিষয়ে আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। গত এক দশকে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুত অর্থের সামান্য অংশ পেয়েছে।



