বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত ধানের সবচেয়ে বড় ভ্যারাইটিজের (জাত) নাম ব্রি ধান ২৯। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা এই জাতটির উদ্ভাবন করেন। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৩০ বছর। দীর্ঘসময় ধরে দেশের মেগাভ্যারাইটিজ হিসেবে ব্রি২৯-এর বিকল্প হয়ে ওঠেনি। জাতীয় বীজ বোর্ডের (এনএসবি) ১১৪তম সভায় এবার ব্রি’র তিনটি জাতের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান১১৩। এই জাতটি বোরো মওসুমের জনপ্রিয় জাত ২৯ এর বিকল্প হিসেবে ছাড়করণ করা হয়েছে।
ব্রি’র সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিধান১১৩ মাঝারি চিকন দানার উচ্চ ফলনশীল জাত। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা এবং ধান পাকলেও সবুজ থকে। পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০২-১০৫ সেমি। এ জাতের গাছ শক্ত এবং মজবুত বিধায় সহজে হেলে পড়ে না। জাতটির গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৯.৪ গ্রাম। চালের আকার আকৃতি মাঝারি চিকন, এবং রং সাদা, দেখতে অনেকটা নাইজারশাইলের মতো। এ ধানের চালে এ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৮.০ ভাগ এবং ভাত ঝরঝরে।
এছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.৪ ভাগ। প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় এ জাতটি ব্রি ধান৮৮ এর চেয়ে ১১.৫ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এ জাতের গড় ফলন হেক্টরে ৮.১৫ টন। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে এ জাতটি হেক্টরে ১০.১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
ব্রি ধান ২৯ এর ক্ষেত্রে বলা হতো-যদি অধিক ফলন চান-ব্রি ধান ২৯ লাগান। ফলনও অন্য যেকোনো ধানের চেয়ে বেশি। এ ধানের চালও খাওয়ার জন্য মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। ফলন ধরা হয় প্রতি হেক্টরে ৭.৫ টন। তবে, নতুন উদ্ভাবিত ব্রিধান ১১৩ হেক্টর প্রতি ফলন ধরা হয়েছে ৮.৫ টন;অর্থাৎ হেক্টর প্রতি এক টন বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিধান ২৮ ও ২৯ চাষ কমাতে সরকারি উদ্যোগ বা চেষ্টা করতে দেখা যায়। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, জাত দু’টি উদ্ভাবনের পর বহু বছর চলে গেছে। ব্লাস্টসহ নানা রোগবালাই সহজেই কাবু করছে। ফলে বিকল্প মেগা ভ্যারাইটিজের খোঁজে যায় ব্রি বা কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ব্রি ধান ৯২সহ আরো কিছু ভাল জাত উঠে এসেছে এই কয়েক বছরে। তবে, এখনো ব্রিধ্ন ২৯ এর বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান ১১৩ কৃষকের কাছে কতটা জনপ্রিয়তা পায় তা আগামীতেই দেখা যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এদিকে, জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১৪তম সভায় ব্রি’র আরো ২টি জাতের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ব্রি’র মহাপরচিালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নতুন উদ্ভাবিত এই তিনটি জাতসহ এখন পর্যন্ত ব্রি সর্বমোট ১২১টি জাত উদ্ভাবন করেছে যার ৮টি হাইব্রিড।
নতুন উদ্ভাবিত তিনটি জাতের মধ্যে ব্রি ধান১১২ লবণাক্ততা সহনশীল ও মাঝারি জীবনকালীন রোপা আমনের জাত। এ জাতের ডিগপাতা প্রচলিত ব্রি ধান৭৩ এর চেয়ে খাড়া। ব্রি ধান১১২ লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টর প্রতি ৪.১৪-৬.১২ টন ফলন দিতে সক্ষম, যা এর মাতৃসারি ব্রি ধান৭৩ এর থেকে ১.০-১.৫ টন/হে. বেশি। এ জাতের জীবনকাল ১২০-১২৫ দিন এবং গাছের উচ্চতা ১০৩-১০৫ সে.মি.। গাছের কাণ্ড মজবুত এবং ঢলে পড়া প্রতিরোধী। এ ধানের শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা গড়ে ২১০টি, যা ব্রি ধান৭৩ এর থেকে ৮০-৯০টি বেশি। চাল মাঝারি চিকন, সাদা এবং ভাত ঝরঝরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রি ধান১১২ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চারা অবস্থায় ১২ ডিএস/মি. (৩ সপ্তাহ পর্যন্ত) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। উপরন্তু এ জাতটি অংগজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সকল ধাপে ৮ ডিএস/মি. মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতটির দানা মাঝারি চিকন ও শীষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। জাতটির জীবনকাল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ফসল কর্তনের পর মধ্যম উঁচু থেকে উঁচু জমিতে সূর্যমূখী ও লবণ সহনশীল সরিষা আবাদের সুযোগ তৈরি হবে।
নতুন উদ্ভাবিত তৃতীয় জাতটি হচ্ছে ব্রি ধান১১৪। এটি বোরো মওসুমের দীর্ঘ জীবনকালীন ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা, গাছ মজবুত এবং হেলে পড়ে না। পাতার রং গাঢ় সবুজ। এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৭.৭৬ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় এর ফলন হেক্টরে ১০.২৩ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ জাতের দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালী বর্ণের। এ জাতের গড় জীবনকাল ১৪৯ দিন, যা বোরো মওসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান৮৯ এর সমান জীবনকাল। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৭.৪ গ্রাম। চালে এ্যামাইলোজের পরমিাণ শতকরা ২৭.০ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৭.৭ ভাগ। ভাত ঝরঝরে। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী।