বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির নতুন সংযোজন মিনি কোল্ডস্টোরেজ। সরকারিভাবে কৃষক পর্যায়ে সবজি চাষিদের জন্য শুরু হয়েছে ছোট হিমাগারের যুগ। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় বাস্তবায়িত ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ডস্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি প্রকল্প’-এর আওতায় সারাদেশে ১০০টি ফারমার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ বিতরণ করা হবে।
বুধবার (২৭ আগস্ট) দেশের সবজি অধ্যুষিত এলাকা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মেদুলিয়া সমন্বিত কৃষক উন্নয়ন সঙ্ঘকে মিনি কোল্ড স্টোরেজের চাবি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
কৃষি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ৬-৭ টন সবজির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মিনি কোল্ডস্টোরেজ বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত শীতের মৌসুমে সবজির দরপতনে কৃষকের আহাজারি দেখে প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন পরীক্ষামূলকভাবে সাভারের রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারের ঘরের ভেতরে, আরেকটি খোলা আকাশের নিচে কনটেইনারভিত্তিক ও সৌরচালিত কোল্ডস্টোরেজ তৈরি করা হয়। আট মাস ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে মিনি কোল্ডস্টোরেজ কৃষকের হাতে গেল।
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষি সিন্ডিকেট করে বড় বড় বিল্ডিং এর মালিক হচ্ছেন। কৃষকরা কুঁড়ে ঘরেই থাকতে হচ্ছে। ফারমারস মিনি কোল্ড স্টোরেজ কেবল ফসল সংরক্ষণ নয়, বরং কৃষি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে এ প্রকল্পকে আরো সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের হাতে প্রযুক্তি পৌঁছে।
তিনি বলেন, মানিকগঞ্জে গাজর, শীতকালিন সবজি বেশী উৎপাদন হয়। এই ব্যবস্থায় কৃষক, ভোক্তার সরাসরি উপকৃত হবেন। এ মিনি কোল্ড স্টোরেজে পরে আরো বাড়ানো হবে। প্রয়োজনে কৃষকরা নিজেরাও বাড়িতে তৈরি করে নিতে পারবেন অল্প খরচে। আমারা কৃষকদের কারিগরি সহায়তা দেবো।
নকল ও ভেজাল বীজের ব্যাপারে উপদেষ্টা বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি কৃষকদের সরাসরি প্রশ্ন শোনেন এবং উত্তর দেন। এতে খাল বেদখল, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগ শুনেন এবং তার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দেন। কৃষি জমি যাতে অন্য খাতে ব্যবহৃত না হয়, সে জন্য আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই কৃষি জমি সুরক্ষা আইন পাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, ‘শিল্প কারখানা ও অন্য অবকাঠামোর জন্য আলাদা জমি থাকবে। সড়ক অধিগ্রহণের সময় সড়ক বিভাগ জমির মালিককে তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দিলেও এলজিইডি কোনো অর্থ দেয় না। নতুন আইন প্রণয়ন হলে এলজিইডির প্রকল্পেও ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা তিনগুণ ক্ষতিপূরণ পাবেন।’
তিনি বলেন, এখান থেকে (মানিকগঞ্জ) কোল্ডস্টোরেজ বিতরণ শুরু হলো, এ রকম ১০০টা দেয়া হবে। এরকম আরেকটি প্রজেক্ট নেয়া হবে। তিনি বলেন, সবজি তো আর সব জায়গায় হয় না। যেসব এলাকায় সবজি হয়, আমরা ওই এলাকা আগে কভার করবো।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর এখন লক্ষ সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনা আধুনিক করা। সোলারভিত্তিক ও মোবাইল অ্যাপ নিয়ন্ত্রিত এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, মিনি কোল্ডস্টোরেজ পুরোপুরি কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি। বাংলাদেশের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এতে স্থানীয় ও আমেরিকান হাই-টেক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। ঘরভিত্তিক টিএসসিআর এবং কনটেইনারভিত্তিক টিএসসিসি-দুটি মডেলের কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করা হয়েছে। সোলারচালিত এ প্রযুক্তিতে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ইন্টারনেটভিত্তিক এবং রিয়েল টাইম তদারক সুবিধা থাকায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘরে বসে এই মিনি কোল্ডস্টোরেজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একটি ঘরভিত্তিক কোল্ড স্টোরেজে ১০ টন পণ্য রাখা যায় এবং খরচ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। কনটেইনার মডেলের খরচ ১৫ লাখ টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত কোল্ড স্টোরেজের তুলনায় এই মিনি সংস্করণের খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ কম। এটি বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমায়—যা ১৪০-১৬০টি গাছের সমান পরিবেশবান্ধব সুবিধা।
প্রকল্প পরিচালক তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে কৃষকরা মৌসুমি সবজি ও ফলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মৌসুমে অতিরিক্ত উৎপাদন হলে বাজারে দাম পড়ে যায়, আর তখন কৃষকের ফসল লোকসানে বিক্রি করতে হয়। এতে কৃষকের পাশাপাশি ভোক্তাও লাভবান হবেন।
তিনি বলেন, এই প্রযুক্তি কৃষকের ঘরেই স্থাপন করা সম্ভব এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। কৃষকের আয় বৃদ্ধি, ফসলের অপচয় কমানো এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
পিডি জানান, ‘ফারমারস মিনি কোল্ড স্টোরেজ প্রকল্পের যাত্রা আমাদের জন্য গর্বের এক মাইলফলক। টমেটো, ফুলকপি, মরিচ, লাউ, আম, ড্রাগন ফলসহ নানা ফসল এতে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে আমরা এ প্রকল্পকে আরও সম্প্রসারণ করতে চাই, যাতে কৃষকের আয় বাড়ে, ফসলের অপচয় কমে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।’
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: ছাইফুল আলম, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা, পুলিশ সুপার মোছা: ইয়াছমিন খাতুন, মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালাক ড. রবীআহ নুর আহমেদসহ প্রায় তিন শতাধিক কৃষক উপস্থিত ছিলেন।