দেশে পাঁচ বছরের ব্যবধানে লেবুজাতীয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে ২৫ শতাংশ ও আবাদ ৪০ শতাংশ। আমদানিনির্ভর মাল্টা, কমলা, লেবু ও বাতাবি লেবুসহ লেবুজাতীয় ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বিদেশে রফতানিও বেড়েছে ২৪২ শতাংশ, যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। এদিকে লেবুজাতীয় এসব ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়লেও প্রায় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে ফসলের চাষ বাড়ানোর পাশাপাশি সারাদেশে বাজার ব্যবস্থাপনা কৃষকবান্ধব করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (২৪ জুন) রাজধানীর কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের সমাপনী কর্মশালায় এসব তথ্য জানানো হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি জুন মাসে শেষ হবে। সমাপনী কর্মশালায় প্রকল্পের অর্জন, মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, সম্ভাবনা ও নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৪৪ কোটি ৯১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। দেশের সাত বিভাগের ৩০টি জেলার ১২৩টি উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান প্রভৃতি পাহাড়ি এলাকার পাশাপাশি সমতলেও যেমন রাজশাহী অঞ্চল, দিনাজপুর অঞ্চল, বরিশাল অঞ্চলসহ প্রভৃতি অঞ্চলেও এ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: ছাইফুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মাহবুবুল হক পাটওয়ারী। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক ড. ফারুক আহমেদ।
কর্মশালায় সংশ্লিষ্টরা জানান, সাইট্রাস বা লেবুজাতীয় ফল বাংলাদেশের সব বয়সী মানুষের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশে মাল্টা, কমলা, লেবু, বাতাবীলেবু এ চার ধরনের সাইট্রাস ফল আবাদ হচ্ছে। সাইট্রাস ফলে ভিটামিন সি, এ, বি, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, আহারোপযোগী আঁশ ও সহজে আত্তীকরণযোগ্য শর্করা অধিক পরিমাণে থাকায় মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
তারা আরো জানান, একজন সুস্থ মানুষের জন্য দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি’র প্রয়োজন। সেই হিসেবে প্রতি বছর ভিটামিন সি’র প্রয়োজন ৪ হাজার ৩৮০ টন। এ ভিটামিন সি’র ৫০ শতাংশ যদি সাইট্রাস ফলের মাধ্যমে নেয়া হয় তবে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন সাইট্রাস ফল প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কমলা, মাল্টা, লেবু, বাতাবি লেবু’র উৎপাদন ছিল ৩০ হাজার ৫২১ টন। যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে মাল্টা ও কমলা আমদানি করতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায় বিদেশে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৮ টন মাল্টা ও কমলা আমদানির পেছনে খরচ হয় ১৯০ কোটি টাকা।
মূলত ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ ও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্যে লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প নেয়া হয়।
কর্মশালায় আরো জানানো হয়, প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার ২৮০ জন কৃষককে লেবুজাতীয় ফসল চাষের আধুনিক কলাকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি লেবুজাতীয় ফলের বিভিন্ন উন্নতমানের চারা ও সারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া কৃষকপ্রতি পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য একটি করে হ্যান্ড স্প্রেয়ার, ওয়াটার সাকার ও অফস্যুট কর্তনের জন্য একটি করে সিকেচার ও কলমের চারা তৈরির জন্য একটি গ্রাফটিং নাইফ বিতরণ করা হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে সাইট্রাস জাতীয় ফসলের আবাদ ও উৎপাদন দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্প শুরুর আগে ২০১৮-১৯ সালে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় যেখানে উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৯০ টন সেখানে ২০২৩-২৪ সালে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৩৮০ টন।
প্রকল্পভুক্ত এলাকায় ২০১৮-১৯ সালে আবাদ এলাকা ছিল ১৩ হাজার ৮০ হেক্টর। সেখানে ২০২৩-২৪ সালে ৪০.৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আবাদ এলাকা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৬০ হেক্টর। মাল্টা, কমলা, লেবু, বাতাবি লেবুর দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আমদানির পরিমাণও অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।
এদিকে প্রকল্পটির আশার দিক হলো সাইট্রাস ফসলের রফতানি বৃদ্ধি। দেশে কলম্বো লেবু, জারা লেবু, সীডলেস লেবু, সাতকড়া প্রভৃতির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে রফতানি ছিল ৭৩৪ টন সেখানে ২০২৩-২৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ হাজার ৭৭৯ টন।
এ প্রকল্পের আওতায় সাইট্রাস জাতীয় ফসলের বিভিন্ন উন্নত জাত সম্প্রসারিত হয়েছে। যেমন- মাল্টার ক্ষেত্রে বারি মাল্টা-১, বাউ মাল্টা-৩ বা ভিয়েতনামী মাল্টা। কমলার ক্ষেত্রে খাসিয়া ম্যান্ডারিন, দার্জিলিং ও পাহাড়ের বড় কমলা। লেবুর ক্ষেত্রে বারোমাসী লেবুর আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে বারি লেবু-১, বিনা লেবু-৪ প্রভৃতির ফলন অধিক হওয়ায় চাষ বেশি হচ্ছে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘কৃষক যে ফসল লাভজনক দেখেন সেই ফসলের দিকে ঝুঁকেন। কিন্তু কখনো কখনো বাম্পার ফলন করেও কৃষক দাম পান না। শ্রম-ঘামের স্বপ্নের ফসল কৃষকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার কৃষকের এমন বঞ্চনা দূর করতে কাজ করছে। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা দূর করতে ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি চাষি ও ভোক্তা দু’জনের কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা সরকার নিশ্চিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে কৃষিতে নতুনত্ব নিয়ে আসার কাজ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৫ বছর মেয়াদি কৃষি পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ফলে চাহিদা এবং উৎপাদনের হিসাব করে কতটুকু উৎপাদন কিভাবে বাড়াতে হবে সেই পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটি ফসল একযোগে সারাদেশে বেশি উৎপাদন হলে চাহিদা কমে যায়। ফলে দামও পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে চাহিদা, উৎপাদন ও অঞ্চলভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে ফসলের আবাদ বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে।’