আনাসের রক্তে আমার কাপড় ভিজে যায় : ট্রাইব্যুনালে অশ্রুসিক্ত মা

২০২৫ সালে জুলাই মাসে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র ছাত্রজনতাকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
সংগৃহীত

চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত দশম শ্রেণির ছাত্র শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দিপ্তী ছয়জন হত্যা মামলার সাক্ষী হয়ে আসামিদের ফাঁসি চাইলেন।

রোববার বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে ছেলেহারা এই মা বলেন, আনাস গেন্ডারিয়া আদর্শ একাডেমির দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ২০২৫ সালে জুলাই মাসে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র ছাত্রজনতাকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সকাল বেলা আনসকে ঘরে না পেয়ে তার রুমে যাই। সেখানে পড়ার টেবিলে একটি চিঠি পাই। চিঠিতে লেখা ছিল, সে মিছিলে যাচ্ছে। সে নিজেকে আটকাতে পারে নাই। চিঠিতে আরো লিখেছে, আমার ভাইয়েরা ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অকাতরে নিজের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একদিন তো মরতে হবে। তাই মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে গুলি খেয়ে মৃত্যু অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয় সেই প্রকৃত মানুষ। যদি বেঁচে না ফিরি কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হইয়ো। চিঠিটি আনাস আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে (এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহীদ আনাসের মা)।

জবানবন্দিতে আনাসের মা বলেন, ওই দিন (৫ আগস্ট) আন্দোলনকারীদের লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। আমি এবং আমার স্বামী আশপাশে আনাসকে খুঁজি কিন্তু পাচ্ছিলাম না। দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল আসে। সে বলে যে আপনাদের কেউ কি আন্দোলনে গেছে? আমি বলি আমার ছেলে গেছে। সে আমাকে দ্রুত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলে। সে আরো বলে, আপনার ছেলের ফোনে আপনার নাম্বার সেইভ করা ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় স্টেচারে পড়ে আছে (এ সময় সাক্ষী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন)। আমি আনাসকে জড়িয়ে ধরি। তখন সৌরভ নামের একটি ছেলে যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সে আমাদের জানায়, আন্দোলন চলাকালে চানখারপুলে পুলিশ টার্গেট করে গুলি করেছিল।

আনাসের মা বলেন, সৌরভ আনাসের ব্যবহৃত ফোন, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকেট ও মৃত্যুর সনদপত্র আমাকে প্রদান করে। মৃত্যু সনদে আনাসের মৃত্যুর কারণ গানশট ও ব্রট ডেড লেখা ছিল। এরপর একটি অটো রিকসায় আনাসেকে কোলে নিয়ে আমরা বাসায় আসি। আনাসের রক্তে আমাদের কাপড় ভিজে যায়। বাসায় আসার পর এলাকাবাসী আনাসের লাশ নিয়ে মিছিল করে। মিছিলে তারা বলে, ‘আমার ভাই মরলো কেন, খুনি হাসিনা জবাব দে।’ একপর্যায়ে আসরের নামাজের পর গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে আনাসের নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আনাসের বাবার কাছ থেকে জানাতে পারি, আন্দোলন চলাকালে চানখারপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদকেও সেখানে জানাজায় জন্য আনা হয়। দু’জনের নামাজের জানাজা একসাথে অনুষ্ঠিত হয়। আনাসকে গোসল দেয়া হয়নি। স্থানীয় একজন মাওলানার পরামর্শে আনাসকে রক্তাক্ত কাপড়ে শহীদী মর্যাদায় দাফন করা হয়।

আনাসের মা জবানবন্দিতে বলেন, আন্দোলনে আনাসের সাথে থাকা সৌরভ ও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানতে পারি যে- ৫ আগস্ট আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে হাজার হাজার আন্দোলনকারী শহীদ মিনারে যাওয়ার পথে চানখারপুল এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ তখন সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়তে থাকে। তারা তখন জীবন বাঁচাতে নবাব কাটারা গলিসহ বিভিন্ন গলির মুখে আশ্রয় নেয়। আনাস নবাবকাটারা গলিতে আশ্রয় নিলে সেখানে একজন পুলিশ আনাসকে লক্ষ্য করে গুলি করে। একটি গুলি আনাসের বুকের বা পাশে লাগে। সাথে সাথে আনাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুলিবিদ্ধ আনাসকে তার সাথের আন্দোলনকারীরা রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন রাব্বীসহ আরো অনেকে এই হত্যার দৃশ্যের ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে। সে ভিডিও সংবলিত পেনড্রাইভ, আনাসের চিঠি, রক্তাত্ত জামা-কাপড়, মৃত্যুর সনদ ও জরুরি বিভাগের টিকেট ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছে।

জবানবন্দিতে আনাসের মা বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি, আন্দোলন দমনের উদ্দেশে ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান ও সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর নির্দেশে এবং আক্তারুল ইসলামের নেতৃত্বে এসি ইমরুল, ওসি আরশাদের উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, ইমাজ ও নাসিবুল নির্বিচারে ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালায়। তাদের গুলিতে আনাস, জুনায়েদ, রাকিব, ইয়াকুব, মামুন ও মানিক শহীদ হয়।

আনাসের মা বলেন, শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের ও আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। আমি হত্যাকারিদের ফাঁসি চাই।

এই মামলায় আজকে পর্যন্ত ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। আজ ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীমসহ প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। পরবর্তীতে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ।

এই মামলায় যে আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তারা হলেন- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ্ আলম মো: আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো: আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো: সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো: নাসিরুল ইসলাম। এই আসামিদের মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। গ্রেফতা চারজনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।