তাপসকে ফোনে হাসিনা

আমি বলছি যা যা পোড়াতে...ও সেতু ভবন পোড়াইছে

‘শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও তিনটি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়। জব্দকৃত কল রেকর্ড থেকে আজ ট্র্যাইব্যুনালে চারটি কল রেকর্ড প্লে করে শোনানো হয়।’

নয়া দিগন্ত অনলাইন
শেখ হাসিনা ও শেখ ফজলে নূর তাপস
শেখ হাসিনা ও শেখ ফজলে নূর তাপস |সংগৃহীত

‘আমার নির্দেশনা দেয়া আছে, ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি, এখন লেথাল ওয়েপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে। আমি বলছি যা যা পোড়াতে..,ও আমাদের সেতু ভবন পোড়াইছে।’

শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথে কথোপকথনের কল রেকর্ডে শেখ হাসিনার এই নির্দেশনাগুলো শোনা যায়। যে কল রেকর্ডটি বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্লে করে শোনানো হয়।

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৫৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আজ জবানবন্দি দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া জবানবন্দিতে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও তিনটি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়। জব্দকৃত কল রেকর্ড থেকে আজ ট্র্যাইব্যুনালে চারটি কল রেকর্ড প্লে করে শোনানো হয়। শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর মধ্যকার একটি কল রেকর্ডের কথোপকথনে শোনা যায় যে....

শেখ হাসিনা : হ্যালো

তাপস : জ্বি, সালামালাইকুম

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, ওয়ালাইকুম আসসালাম

তাপস : জি

শেখ হাসিনা : বল বাবা

শেখ হাসিনা : তুমি নরমাল ফোনে কল দেও ইন্টারনেটের অবস্থা ভালো না

তাপস : নরমাল ফোনেই, নরমাল ফোনেই

শেখ হাসিনা : আচ্ছা বল বাবা

তাপস: জ্বি, সন্ত্রাসীরাতো বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় বিভিন্ন সময় ঘুরতেছে, এখন কোথায় কি আক্রমণ করে যাচ্ছে না তো

শেখ হাসিনা : না, করতেছে আমরা ওদের আবার ব্যবস্থা নিচ্ছি, আর আবাহনী ক্লাবে কি আগুন দিছে

ভাপস : ওরা মনে হয় সচিবালয়ে তো আক্রমণ করছে আবাহনী ক্লাবেও

শেখ হাসিনা : কোথায়?

তাপস : সচিবালয়ে তো আক্রমণ করছে, আপনি জানেন না?

শেখ হাসিনা : না

তাপস : হ্যাঁ, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী তো ওইখানে আছে, সচিবালয়ে কয়েকবার ওরা আক্রমণ করছে, ওরা তো রাতে যদি আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন সংবেদনশীল বাসা-বাড়িতে আক্রমণ করে তাহলে তো ইয়ে হবে

শেখ হাসিনা : রাতের বেলা সব ভিজিলেন্স থাকবে এবং এই এতদিন তো, আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। একটু আন্তে আন্তে অনেক জায়গায় গেদারিং ক্লিয়ার হচ্ছে

তাপস : ওরা মনে হচ্ছে না ইয়ে করবে, রাতে মনে হয় ওদের আরো অনেক কিছু পরিকল্পনা আছে মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো আমাকে তাই বলল, আভাস দিলো এবং আপনাকে ও মনে হয় বলছে কিছু যে রাতে যদি সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ না ইয়ে করে করবেন নাকি?

শেখ হাসিনা : কি করব?

তাপস : মানে সেনাবাহিনী দিবেন?

শেখ হাসিনা : বাবা, একটু চিন্তা করে কথা কইও

তাপস : জ্বি

শেখ হাসিনা : এটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা

তাপস : বুঝতেছি আমি টেকনিকেলি এইটা বুঝতেছি কিন্তু ওরা মনে হয় ওই পথে নেয়ার জন্য ইয়ে করছে

শেখ হাসিনা : দরকার নাই ওটা দরকার নাই আমি সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলছি ওরা রেডি থাকবে ঠিক আছে, এখনতো আমরা অন্য ইয়ে করতেছি। ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি আর হেলিকপ্টারে ইয়ে হচ্ছে মানে কয়েক জায়গায়

তাপস : তাহলে ওই কিছু ছবি দেখে পাকড়াও করা যায় না রাতের মধ্যে

শেখ হাসিনা : সবগুলোকে অ্যারেস্ট করতে বলেছি রাত্রে

তাপস : হ্যাঁ, পাকড়াও করলে ওদেরকে

শেখ হাসিনা : না ওটা বলা হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে র‌্যাব ডিজিএফআই এনএসআই সবাইকে বলা হইছে যে যেখান থেকে যে কয়টা পারবা ধইরা ফেলো

তাপস : জ্বি

শেখ হাসিনা : ওটা বলা আছে, আর যেখানে গেদারিং দেখবে সেখানে ওই ওপর থেকে, এখন ওপর থেকে করাচ্ছি, অলরেডি শুরু হইছে কয়েকটা জায়গায়

তাপস : জ্বি

শেখ হাসিনা : হইয়া গেছে

তাপস : জ্বি জ্বি, মোহাম্মদপুর থানার দিকে মনে হয় ওরা যাচ্ছে এটা আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল

শেখ হাসিনা : মোহাম্মদপুর থানার দিকে

তাপস : হ্যাঁ

শেখ হাসিনা : ওখানে পাঠাইয়া দিক র‌্যাব

তাপস : জ্বি, তাহলে আপনার নির্দেশনা লাগবে

শেখ হাসিনা : আমার নির্দেশনা দেয়া আছে ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি, এখন লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে।

তাপস : জ্বি

শেখ হাসিনা : ওটা বলা আছে আমি এতদিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম। ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল ওদের স্ট্যাডির কথা চিন্তা করে, তারপর তো---ওই

তাপস : না রাতে স্টুডেন্ট না রাতে হলো ওরা সন্ত্রাসী

শেখ হাসিনা : কি করছে তোমার, ঐ যে আমাদের রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের একটা বাচ্চা ছেলে, তার শিক্ষক তাকে ডাইকা নিয়ে আসছে, শিক্ষক নাকি আবার শিবির করতো, ওরা জানে না। তারপর সেই ছেলেটা মারা গেছে, তার মাত্র বুকে একটা গুলি অথচ পুলিশ কিন্তু কোন রিভলবার ব্যবহার করেনি

তাপস : হ...জ্বি

শেখ হাসিনা : এইরকম ঘটনা তারা ঘটাইছে

তাপস : জ্বি আপনি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ইয়ে করেন

শেখ হাসিনা : সব জায়গায় আগুন.. বিআরটি বিটিআরসি বন্ধ করে দিছে, পোড়াইয়া দিছে, বিটিভি পোড়াইয়া দিছে এখনতো ইন্টারনেট বন্ধ সব পোড়াইয়া দিছে, এখন চলবে কিভাবে

তাপস : জ্বি, এটা ভালো হইছে, জ্বি

শেখ হাসিনা : না পোড়াইয়া দিছে, মেশিনপত্র সব পুড়ে গেছে, আমি বলছি যা যা পোড়াতে.., ও আমাদের সেতু ভবন পোড়াইছে

তাপস : জ্বি, ওরা রাতে মনে হয় আরো ব্যাপক আক্রমণ করবে

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেটা পোড়াইছে

তাপস : জি, কারন এই যে আমি ফিরলাম, আমি দেখলাম যে রাস্তায় রাস্তায় ওরা বিভিন্ন জায়গায় ইয়ে করতেছে

শেখ হাসিনা : কোন কোন জায়গায়?

তাপস : বনানীতে ও বনানী গুলশানে তো সচারাচার করে না, কিন্তু বনানী গুলশানে ওরা ইয়েতে চলে আসছে-কোথাও কোথাও ইয়ে করতে পারে মুভমেন্ট আছে সব জায়গায়

শেখ হাসিনা : ঠিক আছে আমি দেখছি

তাপস : জ্বি

শেখ হাসিনা : তোমরা সাবধানে থেকো

তাপস : জ্বি আমি সাবধানে আছি

শে হাসিনা : আচ্ছা

তাপস : ধরপাকড় করতে হবে সব ধরে ফেলতে হবে রাতের মধ্যে

শেখ হাসিনা : না না ওটা বলে দেওয়া আছে অলরেডি, আর একটু আর একটু রাইত গাঢ় হলেই শুরু হবে

তাপস : ফ্রি--জ্বি

শেখ হাসিনা : অন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি

তাপস : জ্বি--জ্বি

শেখ হাসিনা : জ্বি আচ্ছা

তাপস : সালামালাইকুম

এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করছেন। সেইসাথে অপর প্রসিকিউটররা শুনানিতে উপস্থিত থাকেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল। পরবর্তী সময়ে এই মামলার রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এ মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দু’টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে। বাসস