চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ে একটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রসিকিউশন।
আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া অভিযোগটিতে শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হবে বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই প্রসিকিউটর বলেন, গত ১৭ নভেম্বর দেয়া রায় আমরা পেয়েছি। আমরা দেখেছি যে একটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আরেকটা অভিযোগে এই দু’জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে। এই অভিযোগের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হবে।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি (কপি) পেয়েছেন আইনজীবীরা।
গত ১৭ নভেম্বর বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর ঘোষিত ঐতিহাসিক রায়ের পূর্ণাঙ্গ (কপি) অনুলিপি হাতে পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন এই মামলায় সব পক্ষের আইনজীবীরা।
ঘোষিত রায়ে দণ্ডের পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সেই সাথে শহীদদের পরিবারকে এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘হাত, পা, নাক, চোখ, মাথার খুলি হারানো যেসব সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের বাস্তব অবস্থা দেখলে যেকোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা ধরে রাখা কঠিন। ফলে এই অপরাধের সাথে জড়িতদের যেকোনো মূল্যে বিচারের আওয়াতায় আনা উচিত। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ব্যহত হতে দেয়ার সুযোগ নেই।’
মানবতাবিরোধী অপরাধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে শেখ হাসিনাকে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল-১ বলেন, সংঘটিত অপরাধে প্ররোচনা ও উষ্কানি দেওয়া, আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ এবং সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা ও অপরাধ সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়ী। এসব অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হলো।
দুই নম্বর অভিযোগের অপরাধ বর্ণনা করে ট্রাইব্যুনাল-১ বলেন, এই অভিযোগে শেখ হাসিনাকে দু’টি অপরাধের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি অপরাধ হচ্ছে জুলাই গণআন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ। এই নির্দেশনা দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এ ৩(২)(ছ) (জ) ও ৪(১) (২) (৩) ধারার অপরাধ সংঘটন করেছেন। দ্বিতীয় অপরাধটি হচ্ছে, শেখ হাসিনার এই নির্দেশ অনুসরণ করে গত বছর ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও একই দিনে সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়া। এই অভিযোগে সাজা ঘোষণা করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এই সমস্ত অপরাধের জন্য তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বলেন, একই অপরাধে সহ-আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামনু সমানভাবে দায়ী। এর জন্য আসামি আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। কিন্তু আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিষয়ে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে। তাই সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশে তার এই সাক্ষ্য বিচারিক প্রক্রিয়ায় আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করেছে। ফলে তাকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। সবকিছু বিবেচনায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলো।
এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করেন। এছাড়া শুনানিতে প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্য প্রসিকিউটরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। এছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান।
ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বোমোট ৫৪ জন সাক্ষী এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
একপর্যায়ে দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রুভার) রাজসাক্ষী হন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। এখন দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সে সব অভিযোগের বিচার চলছে।
সূত্র : বাসস



