আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তৈরির পেছনে বিদেশী শক্তি জড়িত ছিল বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে সেজন্য শুকরিয়া জানাই। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক হিসেবে এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, বিকাশ ও পতন প্রত্যক্ষ করেছি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্লানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল। ওই প্লানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সাথে একটি বিদেশী শক্তি জড়িত ছিল।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সঙ্ঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ ৪৬তম সাক্ষীর জবানবন্দিতে তিনি আজ এ কথা বলেন।
বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেয়া জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার জন্যে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ১০ মাস আগেই সে নির্বাচনের ফলাফল দিল্লীতে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনে এই ফল হওয়ার পেছনে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করেছিল।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আবশ্যক। কারণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে, তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই একটি বিদেশী শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকারকে মেনে নেবে না। সুতরাং পরিকল্পনা মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ধানমন্ডির এমপি শেখ তাপস সরাসরি জড়িত ছিল।
তৎকালীন সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ সেনা সদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করবার কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং দু’দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিল।
মাহমুদুর রহমান তার জবানবন্দিতে বলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য শেখ হাসিনা সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি করা হয়েছিল আদালতকে ব্যবহার করে। আর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করবার পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে।
মাহমুদুর রহমান জবানবন্দির একপর্যায়ে বলেন, বাংলাদেশে তিন তিনটি নির্বাচনী তামাশা মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং তৃতীয়টি ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে। ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কোনোরকম ভোট প্রদানের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। অর্থ্যাৎ নির্ধারিত ভোটের দিনের আগেই প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই প্রকৃতপক্ষে ভোটদান সমাপ্ত করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের রাতের ভোট প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদূত এই দেশ থেকে তার বিদায়ের আগে সাংবাদিকদের বলে গিয়েছিলেন যে পৃথিবীতে কোথাও ভোটের আগের রাতে ভোট প্রদান সমাপ্ত হয়ে যায় এটা বাংলাদেশেই প্রথম দেখলাম। ২০২৪ সালে আবারো অনেকটা ২০১৪ সালের মতো একতরফা ভোটবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেই নির্বাচনটি ‘আমি ও ডামির ভোট’ হিসেবে কুখ্যাত হয়েছিল।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার জন্য সব ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তিনি ও তার সরকার বিচারবহিঃর্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, গুম করেছে, হেফাযতে নির্যাতন করেছে এবং আয়নাঘর বানিয়েছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে শেখ হাসিনা জঙ্গী দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পিছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ তার সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী, বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
একপর্যায়ে আজকের সাক্ষ্য গ্রহণ আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। আগামীকাল আবার ট্র্যাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেবেন মাহমুদুর রহমান।
এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে আজ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করেন। সেইসঙ্গে অপর প্রসিকিউটররা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে পরে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল। পরবর্তীতে এই মামলার ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন রাজসাক্ষী পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দু’টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ সব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।
সূত্র : বাসস