টেক্সাসের একটি শোধনাগার মার্কিন বিমান সংস্থাগুলোকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সরবরাহ করছে। আমাজন রেইনফরেস্টে অবৈধভাবে পরিষ্কার করা জমিতে লালন-পালন করা গবাদি পশুর চর্বি (ট্যালো)কে পেট্রোলিয়ামভিত্তিক জেট জ্বালানি উৎপাদন করা হয়। এগুলো ডিজেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেল, ডার্লিং ইনগ্রেডিয়েন্টস এবং ভ্যালেরো এনার্জির যৌথ উদ্যোগে টেক্সাসের পোর্ট আর্থারের শোধনাগারে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
মার্কিন জ্বালানি বাজারে প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠান, ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেল। তাদের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সাল থেকে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এটি তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মার্কিন ট্যাক্স ক্রেডিট সংগ্রহ করেছে।
কিন্তু সাক্ষাৎকার এবং নথিপত্রে দেখা যায়, ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেল গত কয়েক বছর ধরে দুটি ব্রাজিলিয়ান কারখানা থেকে কয়েক হাজার টন গরুর চর্বি সরবরাহ করছিলো। তারা এর কিছু অংশ কসাইখানা থেকে সংগ্রহ করেছে যারা আমাজন রেইনফরেস্টের অবৈধভাবে বন উজাড় করা পশু খামারের সাথে যুক্ত।
পরিবেশ প্রতিরক্ষা তহবিলের অর্থনীতিবিদ পেদ্রো পিরিস-কাবেজাস বলেন, “অতিরিক্ত চাহিদা পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বন উজাড় এবং বনের অবক্ষয় ঘটাতে পারে।”
এটি ব্রাজিলের আইন লঙ্ঘনও করতে পারে।
ব্রাজিলের ফেডারেল প্রসিকিউটর রিকার্ডো নেগ্রিনি গবাদি পশু শিল্পের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সরকারি তদন্ত শুরু করেছেন । তিনি বলেছেন, “যেসব কোম্পানি বন উজাড়ের সাথে জড়িত এবং উৎপাদিত কাঁচামাল থেকে লাভবান হয়, তারাও এই অবৈধ কাজের জন্য দায়ী”।
জেটব্লু (জেবিইউ.ও) এবং সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স (এলইউভি.এন) চুক্তি করে "সবুজ" জেট জ্বালানি ব্যবহারের জন্য নতুন ট্যাব খোলে।
ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেলের প্ল্যান্টটি জাতিসংঘের জলবায়ুর প্রভাব নিয়ন্ত্রণকারী করসিয়া (CORSIA) নামক চুক্তির অধীনে তৈরি ।
বিশ্লেষণ সংস্থা স্কাইকোয়েস্ট টেকনোলজি গ্রুপের মতে, ২০২৫ সালে প্রচলিত বিমান জ্বালানির বৈশ্বিক বাজারের পরিমাণ ২৩৯ বিলিয়ন ডলার যেখানে টেকসই জেট জ্বালানির বৈশ্বিক বাজারের পরিমাণ প্রায় ২.৯ বিলিয়ন ডলার। সরকারি প্রণোদনা ব্রাজিলের গবাদি পশু শিল্পকে দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা এবং সম্পদের সঞ্চার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্টেটেন আইল্যান্ড কম্পোস্ট ফ্যাসিলিটিতে, এগুলো 'কালো স্বর্ণ' নামে পরিচিত। ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেল, ডার্লিং ইনগ্রেডিয়েন্টস, ভ্যালেরো এনার্জি, সাউথওয়েস্ট এবং জেটব্লু ব্রাজিলিয়ান ট্যালো সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে বিস্তারিত প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি।
আমাজনের অবৈধভাবে বন উজাড় করা খামার থেকে ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেলে ট্যালো ব্যবসা ট্র্যাক করার জন্য তদন্ত করা হয়েছিলো। আদালতের নথি, কর্পোরেট ফাইলিং, বাণিজ্য তথ্য এবং সরকারি গবাদি পশু ট্র্যাকিং রেকর্ড এ তদন্তে সহায়তা করেছিলো।
গরুর গোশতের ট্যালো সরবরাহের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী, ট্রাক চালক, প্রসিকিউটর, নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালে ডার্লিং ইনগ্রেডিয়েন্টসের সিইও র্যান্ডাল স্টুয়ে, ৫৫৭ মিলিয়ন ডলারে ব্রাজিলের বেশ কয়েকটি প্ল্যান্ট অধিগ্রহণের ঘোষণা দেন। সেই সময় জারি করা এক বিবৃতিতে জানা যায়, “নবায়নযোগ্য ডিজেল এবং টেকসই বিমান জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য বর্জ্য চর্বি” সরবরাহ করবে । যার মধ্যে আমাজন অঞ্চলের ছিলো চারটি।
২০২৫ সালের মে মাসে ফেডারেল প্রসিকিউটরদের দ্বারা পরিচালিত অবৈধভাবে বন উজাড় করা এলাকা থেকে ২০ হাজার গবাদি পশু জবাই করা হয়েছিলো।
তাছাড়া পারা রাজ্যে আরাগুয়াইয়া নামক একটি রেন্ডারিং প্ল্যান্টে কমপক্ষে পাঁচটি গোশত প্যাকার থেকে গরুর চর্বি সংগ্রহ করেছিলো।
ইমপোর্ট জিনিয়াসের বাণিজ্য তথ্য অনুসারে, “২০২৩ সালে, আরাগুয়াইয়া আমাজন থেকে ডায়মন্ড গ্রিন ডিজেলে ৪.৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের গরুর গোশতের ট্যালো রপ্তানি করেছিলো।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাক চালক জানিয়েছেন, “আমি দুই বছর ধরে সাও ফ্রান্সিসকো কসাইখানা থেকে মৃতদেহ তুলে আরাগুয়া প্ল্যান্টে পৌঁছে দিচ্ছি।”
আরও দুই চালক এবং সাও ফ্রান্সিসকোর দুই কর্মচারী নিশ্চিত করেছেন, কসাইখানাটি আরাগুয়াইয়ার সরবরাহকারীই ছিলো।
সাও ফ্রান্সিসকো বলেছে যে, “২০১৮ সাল থেকে ফেডারেল প্রসিকিউটরদের সাথে সহযোগিতা করে আসছে এবং পর্যবেক্ষণের জন্য একটি বাইরের সংস্থা নিয়োগ করেছে।”
ব্রাজিলের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইবামার মতে, “সাও ফ্রান্সিসকো তাদের কিছু গবাদি পশু পরোক্ষভাবে ভ্যালে দো প্যারাইসো থেকে সংগ্রহ করে।”
তাদের তথ্য অনুসারে, “২০০৬ সাল থেকে ১৫ বর্গমাইল গাছ অবৈধভাবে কেটে ফেলার কারণে এই খামারে গবাদি পশু চরানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো।”
গবাদি পশু ট্র্যাকিং তথ্য থেকে দেখা যায় যে, “কসাইখানায় পৌঁছানোর আগে ভ্যালে দো প্যারাইসো থেকে গবাদি পশুগুলোকে একটি খামারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো।”
সরকারি নথি অনুসারে, ভ্যালে ডো প্যারাইসোর মালিক আন্তোনিও লুসেনা ব্যারোস এখনও বন উজাড়ের জন্য ৩ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি জরিমানা বকেয়া রেখেছেন।
ব্যারোসের আইনজীবী ক্যালেবে রোচা এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তার মক্কেল আদালতে জরিমানার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং জরিমানা প্রদান স্থগিত করার জন্য একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভ্যালে ডো প্যারাইসোর যে অংশটি ইবামা বন উজাড়ের কারণে অবরুদ্ধ করেছিলো, সেখান থেকে কোনও প্রাণী বিক্রি করা হয়নি।”
ডার্লিং ইনগ্রেডিয়েন্টসের মালিকানাধীন আরেকটি প্লান্ট একটি কসাইখানা থেকে চর্বি সংগ্রহ করেছে। সংস্থাটি নিশ্চিত করেছে, “তারা ২০২২ এবং ২০২৩ সালে শত শত গবাদি পশু খামার মালিক ব্রুনো হেলারের কাছ থেকে কিনেছিলো।” ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ ২০২৩ সালের তদন্তে আমাজনের সবচেয়ে বড় বন উজাড়কারী হিসেবে বর্ণনা করেছে।
২০৫০ সালের মধ্যে জিরো নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য, বিমান সংস্থাগুলো আরও বেশি পরিবেশবান্ধব জেট জ্বালানি কিনতে চায়। যা এখন অল্প পরিমাণে উৎপাদিত হয় ।
ব্রাজিল থেকে হীরার আমদানি ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড কার্বন সার্টিফিকেশন (ISCC) দ্বারা টেকসই হিসেবে দেখা হয়েছে। এটি তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন সংস্থা (CORSIA)’র জন্য ডায়মন্ডের প্ল্যান্টকে অনুমোদন দিয়েছে।
আইএসসিসি (ISCC) জানিয়েছে, “তারা ডায়মন্ড সরবরাহের তদন্ত করেনি কারণ তারা ট্যালোকে করসিয়া’র অধীনে গরুর গোশত শিল্পের একটি "উপজাত" বলে মনে করে।”
করসিয়া ডিজাইনে সহায়তাকারী তিনজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন যে, “এই কর্মসূচির মাধ্যমে উৎপাদকরা কার্বন নিঃসরণ এবং আমাজন রেইনফরেস্টের বন উজাড় থেকে বের হতে পারবেন।”
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও) ট্যালো সরবরাহ বন উজাড়কে টেকসই মান লঙ্ঘন হিসেবে দেখে কিনা জানতে চাইলে তারা কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে, সংস্থাটি বলেছে যে তারা টেকসই বিমান জ্বালানি উৎপাদনকারীদের প্রত্যয়িত করার জন্য দায়ী তৃতীয় পক্ষের উপর নিয়মিত নজর রাখছে।